সংবিধান পুনর্লিখন করতে হবে: আলী রীয়াজ

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঠিক করতে কনস্টিটিউশনাল অ্যাসেম্বলি (গণপরিষদ) করে হলেও সংবিধান পুনর্লিখন জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল বৃহস্পতিবার সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক আলী রীয়াজ এ মন্তব্য করেন। সিজিএসের উপদেষ্টা তার মূল বক্তব্য তুলে ধরার পর প্রশ্নোত্তর পর্বে দেশের সংবিধান, গণতন্ত্র, নির্বাচনসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, সংবিধানের পুনর্লিখন করতে হবে। এর বাইরে আপনি প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করতে পারবেন না।’

সরকারপ্রধান হিসেবে একজন সর্বোচ্চ কত মেয়াদে থাকতে পারবেন, এমন প্রশ্ন উঠলে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই মার্কিন অধ্যাপক বলেন, ‘দুই মেয়াদ, নাকি তিন মেয়াদÑএই প্রশ্নটা থেকে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সরকারপ্রধান হিসেবে একই ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুই মেয়াদ থাকতে পারেন।’
গণপরিষদের প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, ‘সংবিধান পুনর্লিখনের কথা বলছিÑ এই কারণে যে সংবিধান সংশোধনের উপায় নেই। বর্তমান সংবিধান সংশোধনের উপায় সীমিত। কারণ সংবিধানের এক-তৃতীয়াংশ এমনভাবে লেখা যে তাতে হাতই দেয়া যাবে না। এর মধ্যে এমন সব বিষয় আছে, যেগুলো না সরালে কোনো কিছুই করতে পারবেন না। এ কারণে পুনর্লিখন শব্দটা আসছে। পুনর্লিখনের পথ হিসেবে গণপরিষদের কথা বলছি। আর কোনো পথ আছে কি না, আমি জানি না।’

টিআইবির প্রস্তাবিত একই ব্যক্তি ‘দলীয় প্রধান, সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না’Ñ এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আলী রীয়াজ বলেন, ক্ষমতা যাতে এক হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়, সেটাই টিআইবি বলেছে। এসব সংস্কার জরুরি। ক্ষমতার কেন্দ্রভূত করার এসব পথ সাংবিধানিকভাবে বন্ধ করা না হলে ভবিষ্যতে আরও একজন স্বৈরাচার তৈরির পথ বন্ধ করা যাবে না। ভারতীয় গণমাধ্যমের অপতথ্য প্রসঙ্গে আলী রীয়াজ বলেন, ‘ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো ৫ আগস্ট থেকে যেসব অপতথ্য (ডিসইনফরমেশন) ও ভুল তথ্য (মিসইনফরমেশন) প্রচার করছে, সেগুলোর বড় জবাব হচ্ছে সত্য ঘটনা তুলে ধরা। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে। আমি তাদের বলেছি, আপনারা ঢাকায় যান, দেখুন, তারপর তা তুলে ধরুন। একই কথা আপনাদের (সাংবাদিক) জন্যও। আপনারা সত্য তথ্য তুলে ধরুন।’

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে নাগরিকদের সংলাপের যে আহ্বান জানিয়েছেন, সেই প্রেক্ষাপট তুলে ধরে ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির এই অধ্যাপক বলেন, টেকসই গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন সংলাপের আয়োজন করে সেগুলোর মাধ্যমে দেশব্যাপী নাগরিক সমাজ, সুশীল সমাজ এবং বিভিন্ন খাতের বিশেষজ্ঞদের মতামত ও পরামর্শ সংগ্রহ করা হবে। তার ভিত্তিতে ভবিষ্যতের একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ প্রণয়ন সম্ভব হবে, যা গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়াকে সহজতর এবং দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।

আগামী পাঁচ মাস জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে সিজিএস ধারাবাহিক সংলাপের আয়োজন করবে উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, জাতীয় পর্যায়ের সংলাপের অংশ হিসেবে ঢাকায় আটটি জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে। এতে বিষয়বস্তুর মধ্যে থাকছে সংবিধান, মানবাধিকার ও গুরুতর আইন লঙ্ঘনের শিকার ভুক্তভোগীদের বিচার নিশ্চিতকরণ, বিচারব্যবস্থা, নাগরিক প্রশাসন, সাংবিধানিক সংস্থা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, অর্থনৈতিক নীতিমালাসহ ব্যাংকিং খাত ও বৈদেশিক ঋণ এবং গণমাধ্যম।

এই অধ্যাপক আরও বলেন, ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট ও খুলনায় চারটি আঞ্চলিক সংলাপ হবে। এতে অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের প্রত্যাশা, প্রস্তাবনা ও সুপারিশ খোলাখুলি প্রকাশ করতে পারবেন।
আলী রীয়াজ বলেছেন, দীর্ঘ ১৫ বছর এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনের কারণে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে। বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নির্বাচন ব্যবস্থাÑসবই পরিকল্পিতভাবে রাজনীতিকরণ হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে ড. আলী রীয়াজ বলেন, ছাত্র-জনতার অভাবনীয় অভ্যুত্থানে প্রায় এক হাজার প্রাণহানি হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিশাল পরিবর্তন হয়েছে।
আলী রীয়াজ বলেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নীতিমালা জনগণের কল্যাণের পরিবর্তে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর মুনাফা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে পরিচালিত হয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও জ্বালানি খাতে স্বার্থবাদী একটি নেটওয়ার্ক গঠিত হয়েছিল, যারা নিজেদের স্বার্থে এই গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ঋণখেলাপিদের বিচার থেকে রক্ষা করা হয়েছে। বিগত সরকারের সঙ্গে যুক্ত একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী জ্বালানি খাতের ভর্তুকি পকেটে ভরেছে।

এই সবকিছুর পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজন এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় দেশকে ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি সংবিধানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংস্কার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। গণজাগরণের মাধ্যমে তৈরি হওয়া আশা ও প্রত্যাশা পূরণ করতে সরকারের ওপর বিশাল দায়িত্ব আরোপিত হয়েছে।
জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে অনুষ্ঠিত প্রতিটি সংলাপের আলোচনা এবং নির্দিষ্ট সুপারিশের সারসংক্ষেপ সিজিএস প্রকাশ করবে এবং গণমাধ্যমে প্রকাশের মাধ্যমে তা সবার কাছে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করবে।
সংবাদ সম্মেলনে সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমাদের অনেক কিছু করার আছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে চাই। সে লক্ষ্যে সিজিএস ধারাবাহিক সংলাপের আয়োজন করেছে।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০