Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 12:42 pm

সংশোধন না পুনর্লিখন: কোন পথে সংবিধানের ভবিষ্যৎ?

এম তাওহিদ হোসেন: সংবিধান হলো রাষ্ট্র পরিচালনার মূল দলিল, সংবিধানকে রাষ্ট্রের দর্পণ হিসেবেও অভিহিত করা হয়। অধ্যাপক সি এফ স্ট্রং তার মডার্ন পলিটিক্যাল কনস্টিটিউশন গ্রন্থে উল্লেখ করেছেনÑ সংবিধান হলো এমন কতগুলো নীতির সমষ্টি যার মাধ্যমে সরকারের ক্ষমতা, শাসিতের অধিকার ও উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক নির্দিষ্ট হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের দীর্ঘ প্রায় ২৪ বছরের শাসনের পর ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। দীর্ঘ প্রায় ২৪ বছরের শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস থেকে মুক্ত হয়ে এ দেশের জনগণ একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের মাধ্যমে জনকল্যাণ ও জনগণের আশা আকাক্সক্ষা ধারণ করে এমন একটি সংবিধান চেয়েছিল যার প্রতিফলন ঘটে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মাধ্যমে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান রচনা করে। যুদ্ধ বিধস্ত একটি দেশে এত অল্প সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দলিল সংবিধান প্রণয়ন করে জন আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন প্রশংসনীয় ছিল কিন্তু কালের পথপরিক্রমায়, উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক অভিলাষে এ প্রশংসনীয় কাজটি নিন্দনীয় কাজে পর্যবসিত হয়েছে। মাত্র ৫১ বছরের ব্যবধানে সংবিধানকে ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে যা পৃথিবীর ইতিহাসে খুবই বিরল। সংবিধানের ১৭ বার সংশোধনের মাধ্যমে এটাও বোঝা যায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কতটা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। বাংলাদেশের প্রত্যকটা রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকাকালীন সংবিধানের স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য নষ্ট করেছে। তাই আজ আবার প্রশ্ন উঠেছে সংবিধানের সংশোধন না পুনর্লিখন?

সংবিধানের সংশোধন না পুনর্লিখন এই প্রশ্নে সংশোধন বিষয়ে সবাই অবগত থাকলেও পুনর্লিখন অনেকের কাছেই অবাক করা বিষয়। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে আদৌ কী সংবিধানের পুনর্লিখনের নজির পৃথিবীতে আছে? সংবিধানের পুনর্লিখন কী আদৌ সম্ভব? কীভাবে সংবিধানের পুনর্লিখন করা যাবে? কাদের সংবিধানের পুনর্লিখন করা উচিত? সংবিধানের সংশোধন না পুনর্লিখন প্রশ্ন সামনে চলে আসে জুলাই আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে গড়ে ওঠা কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে গড়ে ওঠা প্রথমে কোটা সংস্কার আন্দোলন হলেও পরবর্তী সময়ে জন আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে রূপ নেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলনে। জুলাই আগস্ট মাসে ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে অন্তবর্তীকালীন সরকার। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কী দেশে বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী বৈধ? উত্তর হচ্ছে দেশে বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী এই সরকার বৈধ না কেননা তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ৩ জুলাই ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বৈধ না। পঞ্চদশ সংশোধনীতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটবিহীন সরকারকে অবৈধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আরও একটি প্রশ্ন হচ্ছে ছাত্র-জনতার এই আন্দোলন কী গণ-অভ্যুত্থান না বিপ্লব?

জুলাই আগস্ট মাসের ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে বিপ্লব বললে বিপ্লব শব্দের ভুল সজ্ঞায়ন করা হবে। কেননা বিপ্লব একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, যার নির্দিষ্ট কিছু আদর্শগত দিক থাকে যে আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থায় অপরিচিত বা অনুপস্থিত ছিল। বিপ্লব মানে নতুন একটা আদর্শকে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অভিযোজন ঘটানো। জুলাই আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সেরকম আদর্শগত কোনো বিষয় ছিল না মোটা দাগে বলতে গেলে একটি নির্দিষ্ট শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন ছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেটি চলমান সাংবিধানিকভাবে অবৈধ এবং বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাধ্যমেও রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসেনি, তাদের কী সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখনের ক্ষমতা আছে?

প্রথমত বলি এই সরকার চলমান সংবিধান অনুযায়ী অবৈধ হলেও সাংবিধানিক অচলাবস্থা পূরণের জন্য বৈধ। সংবিধানের কিছু আক্ষরিক সৌন্দর্য আছে, যে সৌন্দর্য সাংবিধানিক অচলাবস্থা বা দেশের ক্রান্তিকালে পথ বাতলে দেয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও ডকট্রিন অব নেসেসিটি বৈধতা দেয়, সেই সঙ্গে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কাছে জনগুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে আইনগত প্রশ্ন উত্থাপিত হলে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সে বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইতে পারেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়েও রাষ্ট্রপতির এমন ব্যাখ্যা চাওয়ার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এই সরকারকে বৈধতা দিয়েছে, তারমানে এই সরকার বৈধ। তাহলে বিপ্লবের প্রশ্নে এই সরকার কী সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখন করতে পারে কী না? এখানে একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে জুলাই আগস্ট মাসের ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে আক্ষরিক অর্থে বিপ্লব না থাকলেও রূপক অর্থে বিপ্লব বলা যাবে কেননা এখানে গণমানুষের জমায়েত ঘটেছিল, জনমানুষের রক্ত ঝরেছিল, গণ-আকাক্সক্ষা ছিল। তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা ও বৈপ্লবিক ইস্যুতে এই সরকারের সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখনের ক্ষমতা রয়েছে।
এবার আসি আমার করা শুরুর দিককার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে। আমি আমার লেখায় প্রথমত প্রশ্ন রেখেছিলাম সংবিধানের পুনর্লিখনের ইতিহাস বা নজির কী পৃথিবীতে আছে? উত্তর হচ্ছে সংবিধানের পুনর্লিখন করার ইতিহাস পৃথিবীতে আছে। ২০০৮ সালে আইসল্যান্ডে অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য সংবিধানকে পুনর্লিখন করা হয়েছিল যদিও পরবর্তী সময়ে কাজে দেয়নি, ২০১২ সালে বিপ্লবের পর মিশরের সংবিধানকে পুনর্লিখন করা হয়েছিল, চিলিতে ২০১৯ সালে ব্যাপক গোলযোগের পর সংবিধান পুনর্লিখন করা হয়েছিল যা ২০২২ সালে গণভোটের অধীনে রাখা হয়, ২০১১ সালে আরব বসন্তের পর ২০১৪ সালে তিউনিসিয়া সংবিধানকে পুনর্লিখন করেছিল, ১৯৯৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সংবিধান পুনর্লিখন করেছিল যা প্রগতিশীল সংবিধান হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই সংবিধানের পুনর্লিখন যদি বাংলাদেশে হয় তা নতুন কোনো নজির হবে না বরং নজিরে নতুন একটা দেশ যুক্ত হবে।

আমার দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রশ্ন রেখেছিলাম সংবিধানের পুনর্লিখন আদৌ কী সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তরের ওপরই নির্ভর করছে সংবিধানের ভবিষ্যৎ এবং কারা করবে সংবিধানের পুনর্লিখন নামক প্রশ্নের উত্তর। সংবিধানের সংশোধন বা পুনর্লিখনের প্রশ্ন আসে তখন যখন জনআকাক্সক্ষা সংবিধান ধারণ করতে পারে না, বা ছলচাতুরির মাধ্যমে জনআকাক্সক্ষাকে সংবিধানে উপেক্ষা করা হয়। বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য বারবার সংবিধানকে সংশোধনের নামে কাটাছেঁড়া করেছে, সংবিধানের এমন এমন সংশোধনী এনেছে যা সময়ের প্রয়োজনে ও জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য যে সংস্কার দরকার সেই সংস্কার যেন না করতে পারে তার বন্দোবস্ত করে রেখেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৭ (খ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সব অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সব অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলি সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সব অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলি সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হবে অর্থাৎ কোনভাবেই উক্ত বিষয়গুলো পরিবর্তন করা যাবে না, পঞ্চম সংশোধনীতে ওই বিষয়গুলো পরিবর্তনের জন্য রাখা হলেও পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তা বাতিল করা হয়। কার্যত এখানে সংবিধানকে একপাক্ষিক করে দেয়া হয়েছে এবং জনআকাক্সক্ষাকে উপেক্ষিত করা হয়েছে। কাজেই সংবিধানের পুনর্লিখন কোনো রাজনৈতিক সরকার নয় বরং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেই করা উচিত।

সংবিধানকে সংশোধন না পুনর্লিখন প্রশ্নে আরও একটি বিষয় ওঠে আসে সেটি হচ্ছে সংবিধানকে আদৌ সংশোধন করা যায় কী না? সংবিধানকে জনআকাক্সক্ষা ধারণ করতে হলে সংবিধানের সংশোধন নয় পুনর্লিখন জরুরি কেননা, ৭(খ) অনুচ্ছেদে ইতোমধ্যে বেশ কিছু জটিলতার বিষয় উল্লেখ করেছি, যেখানে সংশোধন করার মতো কোনো অবস্থা রাখা হয়নি সেই সঙ্গে কেউ সংশোধন করার উদ্যোগ গ্রহণ করলে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল হিসেবে আখ্যায়িত করার বিধান রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানের ৭ (ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায় এই সংবিধান বা এর কোনো অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করলে কিংবা সেটি করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করলে তার এই কাজ রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে এবং ওই ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হবেন। আর এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে (মৃত্যুদণ্ড) দণ্ডিত হবেন। এই বিধানের আলোকে সংবিধান সংশোধন করে যদি কিছু অনুচ্ছেদ বাতিল করা হয় তাহলে যে বাতিল করেছে সে দেশদ্রোহী হিসেবে গণ্য হবে। তাই সংশোধন করে বাতিল ও বাতিল করা উভয়তেই যেহেতু মৃত্যুঝুঁকি আছে সেহেতু সংশোধনের চেয়ে পুনর্লিখন করে বাতিল করাকে অধিক শ্রেয় বলে মনে হয়। আর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাংবিধানিক বৈধতার প্রশ্ন ও গণআস্থার মানদণ্ডের প্রশ্নের উত্তর আমি ইতোমধ্যে দিয়েছি। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সংবিধান পুনর্লিখন বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া বলে মনে করি।

এবার আসি আমার এই লেখার প্রারম্ভে করা আরও একটি প্রশ্নের উত্তরে যে সংবিধানের পুনর্লিখন হবে কীভাবে? উত্তর হচ্ছে সংবিধানের পুনর্লিখনের জন্য গণপরিষদ গঠন করে গণভোটের আয়োজন করে গণরায়ের ভিত্তিতে সংবিধান পুনর্লিখন করতে হবে। সংবিধানের সংশোধন না পুনর্লিখন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ড. আলী রিয়াজের প্রস্তাবিত তিনটি প্রস্তাবের মধ্য থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় প্রস্তাব অর্থাৎ গণপরিষদ গঠন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে গণভোট আয়োজন করে জনমতের ভিত্তিতে সংবিধান পুনর্লিখন করা যেতে পারে আমি এখানে এই দুটি প্রস্তাবকে সংমিশ্রণ করে সংবিধান পুনর্লিখন করার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
সংবিধান সংশোধন না পুনর্লিখন এই বিষয়ে বর্তমানে অনেক কথা হচ্ছে, নানা মহলে নানা আলোচনা চলছে। কেউ বলছে সংশোধন আবার কেউ বলছে পুনর্লিখন। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা আছেন সময়ের ব্যবধানে তারাই ঠিক করবেন সংবিধানের ভবিষ্যৎ। আমাদের মতো সাধারণ জনগণের একটাই চাওয়া সংবিধানে জনগণের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটুক, সব কালা কানুন বর্জিত হোক সংবিধান থেকে, কোন দল বা বিশেষ গোষ্ঠীর হয়ে কথা না বলুক সংবিধান সংবিধান বরং কথা বলুক এ দেশের আপামর গণমানুষের হয়ে।