সক্ষমতা অনুযায়ী ঋণপত্র খুলছে ব্যাংকগুলো

রোহান রাজিব: দেশে তীব্র ডলার সংকটের কারণে কয়েকটি ব্যাংক আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা কমিয়ে দেয় এবং অনেক ব্যাংক খোলা বন্ধ করে দেয়। ডলারের দাম বৃদ্ধি, চাহিদার তুলনায় জোগান কম, বিদেশি ব্যাংকের দায় পরিশোধ এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর ঋণসীমা কমিয়ে আনার কারণে ব্যাংকগুলোয় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সবমিলিয়ে ব্যাংকগুলো এলসি খোলা নিয়ে আতঙ্কে পড়ে যায়। এতে বিপাকে পড়ে দেশের আমদানিকারকরা। তবে এখন ব্যাংকগুলো বিদেশি ব্যাংকগুলোর আগের দায় পরিশোধ করে তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী নতুন এলসি খুলছে। দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমনটা জানা যায়। 

ব্যাংকাররা জানান, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয়ের ওপর নির্ভর করে এখন সব ব্যাংক নতুন এলসি খুলছে। আগের মতো ঢালাওভাবে এলসি খুলছে না। আগে বিচার-বিবেচনা ছাড়াই এলসি খোলা হতো। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী পণ্যের দাম যাচাই-বাছাই করেই খোলা হচ্ছে এলসি।

তবে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্পর্ক ও তদবিরের মাধ্যমে এলসি খোলায় বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। যেসব ব্যবসায়ীর সঙ্গে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) ভালো সম্পর্ক রয়েছে, তারাই এলসি খুলতে পারছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের তদবিরের মাধ্যমে বড় বড় ব্যবসায়ীর এলসি খুলছে ব্যাংকগুলো। এক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছে ছোট ব্যবসায়ীরা।

দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, ডলার থাকলেই কেবল এলসি খোলা হচ্ছে। কারণ ডলার না থাকা সত্ত্বেও এলসি খুললে নিষ্পত্তির সময়ে ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে বাংলাদেশ ও ব্যাংক ডিফল্টার হবে। তাই এখন আয় দেখে ব্যয় করছে ব্যাংক। এছাড়া এখন আগের খোলা ইউপাস এলসির পেমেন্ট শুরু হয়েছে। তাই ব্যাংকগুলোর একটা টাইট সময় যাচ্ছে। আশা করি আগামী ফেব্রুয়ারিতে অবস্থা স্থিতিশীল পর্যায়ে চলে আসবে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, বর্তমানে ব্যাংকগুলো রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয়ের ওপর নির্ভর করে ঋণপত্র খুলছে। এর বাইরে কেউ ঋণপত্র খুলছে না। এটাই স্বাভাবিক। কারণ কোনো ব্যাংক বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হতে চাইবে না। বিদেশি ঋণ পরিশোধ করার পর যে ডলার থাকে, তা দিয়ে নতুন এলসি খোলা হচ্ছে।

দেশের প্রায় এক ডজন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা জানান, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির এলসি খুলতে প্রাধান্য বেশি দেয়া হচ্ছে। ঢালাওভাবে কোনো প্রকার এলসি খোলা হচ্ছে না। যারা আমদানি করছে, তাদের পণ্য যাছাই-বাচাই করেই খোলা হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তৃতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালাক নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, এলসি খুলতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো নিষেজ্ঞাধা ছিল না। আমাদের এলসি খুলতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ডলারের চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলছি।

গত বৃহস্পতিবার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) আয়োজিত এ সেমিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ডলার সংকটে আমদানি করা যাচ্ছে না বলে যে কথা বলা হচ্ছে, তা মোটেও ঠিক নয়। পণ্য আমদানিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো বাধা দেয়া হচ্ছে না। সঠিক দরে এলসি খুলতে বাধা নেই। ব্যাংক এলসি খুলতে পারলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো সমস্যা নেই।

পণ্য আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগে গড়ে প্রতি মাসে আট বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হতো। এখন তা পাঁচ বিলিয়নে নামিয়ে আনা হয়েছে। এতে ডিসেম্বর নাগাদ ব্যালেন্স অব পেমেন্টের যে ঘাটতি, তা আর থাকবে না। বর্তমান যে ঘাটতি রয়েছে, তা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আমদানি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে নতুন এলসি কমছে। যদিও বাকি বা দেরিতে পরিশোধের শর্তে আগে খোলা এলসির দায় পরিশোধ বেড়েছে, যে কারণে বৈদেশিক মুদ্রার খরচ কমেনি। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে এলসি খোলা ১৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ কমলেও আমদানির দায় পরিশোধ বেড়েছে ২৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ। কারণ এলসি খোলার সঙ্গে সঙ্গে কোনো পণ্য আমদানি হয় না। বেশিরভাগ এলসির দেনা পরিশোধ হয় পণ্য দেশে আসার পর। অবশ্য সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেশিরভাগ আমদানি হচ্ছে বায়ার্স ক্রেডিট বা ডেভার্ড পেমেন্টের মাধ্যমে। এ উপায়ে পণ্য পাওয়ার পর নির্ধারিত সময় শেষে এলসির দায় পরিশোধ করতে হয়।

নতুন আমদানির এলসি খোলা প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনার তথ্য দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। চলতি বছরের মার্চে দেশের ব্যাংকগুলোয় এলসি খোলা হয়েছিল ৯৮০ কোটি ডলারের। অক্টোবরে নতুন এলসি খোলার পরিমাণ ৪৭৪ কোটি ডলারে নামিয়ে আনা হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৮ শতাংশ কম। গত সেপ্টেম্বরেও আট বিলিয়ন ডলারের ঋণপত্র খোলা হয়েছিল। সেই হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে ঋণপত্র খোলা প্রায় অর্ধেক কমে গেছে।

এদিকে চলতি মাসের ১ থেকে ১৬ নভেম্বর ঋণপত্র খোলা হয়েছে ১ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারের, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৩ শতাংশ কম। গত জুলাই থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত সব মিলিয়ে ঋণপত্র খোলা হয়েছে ১৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ বিলিয়ন ডলারের। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৩০ শতাংশ কম। তবে ঋণপত্র খোলা কমলেও ঋণপত্র নিষ্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় পাঁচ শতাংশ। মূলত আমদানি কমাতে শতভাগ এলসি মার্জিন নির্ধারণের পাশাপাশি এলসি খোলার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তি নিতে হচ্ছে। এছাড়া ব্যাংকগুলোর অপারগতার কারণে আমদানির এলসি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।

দেশে কভিড প্রকোপ শুরু হয় ২০২০ সালের মার্চে। এ সময় অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখতে নানা ধরনের ছাড় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমদানি দায় পরিশোধের সময় ১৮০ দিন থেকে বাড়িয়ে ৩৬০ দিন করা হয়। রপ্তানি আয় দেশে আনতেও বাড়তি সময় দেয়া হয়।

ফলে অনেক আমদানি দায় অপরিশোধিত থেকে যায়। অনেক রপ্তানি আয় দেশে আসেনি। তবে কভিডকালে বৈধ পথে প্রবাসী আয় আসায় নতুন রেকর্ড হয়। তাতে রিজার্ভ পৌঁছে যায় ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড উচ্চতায়। করোনার সময় রেকর্ড প্রবাসী আয় দেশে আসে। তাতে ডলারের দাম ধরে রাখতে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজার থেকে প্রায় ৮০০ কোটি ডলার কিনে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত রিজার্ভ থেকে ৭৬২ কোটি ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ ধারা অব্যাহত রয়েছে চলতি অর্থবছরেও। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৩৪ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারে। রিজার্ভে টান পড়ায় এখন বেসরকারি খাতে কোনো ডলার বিক্রি করছে না বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে রিজার্ভ এখন ৩৪ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার হলেও প্রকৃত রিজার্ভ ২৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। কারণ রিজার্ভ থেকে প্রায় আট বিলিয়ন ডলার বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করা আইএমএফের প্রতিনিধিদল রিজার্ভ হিসাবের ক্ষেত্রে প্রকৃত তথ্য প্রকাশের সুপারিশ করে। তাতে সম্মত হয় বাংলাদেশ ব্যাংকও।

জ্বালানি ও খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে গত এপ্রিল থেকে দেশে ডলারের সংকট দেখা দেয়। এরপর সংকট সামাল দিতে ব্যাংকগুলো বেশি দামে প্রবাসী আয় আনা শুরু করে। এতে ডলারের দাম ১১৫ টাকা ছাড়িয়ে যায়। তাতে বাংলাদেশ ব্যাংক নড়েচড়ে বসে। প্রথমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই ডলারের দাম নির্ধারণ করে দেয়। পরে ডলারের দাম বেঁধে দেয়ার দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া হয় ব্যাংকগুলোর কাছে। গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাফেদা মিলে ডলারের দাম ঠিক করছে। এবিবি ও বাফেদার বেঁধে দেয়া দাম অনুযায়ী এখন প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম সর্বোচ্চ ১০৭ টাকা। সংগঠনটির ঘোষণা অনুযায়ী, গত রোববার সর্বোচ্চ ১০৬ টাকা ৯০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করেছে ব্যাংকগুলো, যা গত বছর ছিল ৮৫ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে ডলারের দাম বাড়ে ২১ টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদ শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যাংকগুলো রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় অনুযায়ী এলসি খুলবে। এখন তারা ডলারের জোগান অনুযায়ী এলসি খুলে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। সরকারি আমদানি বিলে ডলার জোগান দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ভবিষ্যতেও এটা অব্যাহত থাকবে। এছাড়া ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি অব্যাহত রয়েছে।

বিষয় ➧

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০