আফরোজা নাজনীন: চোখ একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল অঙ্গ, যা দিয়ে আমরা এই সুন্দর পৃথিবী দেখতে পাই, এর রূপ উপভোগ করি। চোখে দেখতে না পাওয়া মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ।
১২ বছরের শিশু নয়ন, কিন্তু তার নয়নে আলো নেই। মাত্র চার বছর বয়সে ছানি পড়ে তার চোখের আলো নিভে গেছে। সময়মতো চিকিৎসা না করায় একসময় পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যায় সে। নয়ন এখন রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বেড়িবাঁধ এলাকায় বসে ভিক্ষা করে। তার মা সকালে তাকে বসিয়ে দিয়ে যায়, বিকালে নিয়ে যায়। নয়নের চোখের চিকিৎসা হয়েছে কি না এ প্রশ্নের জবাবে তার মা সালেহা বেগম জানান, আমাদের বাড়ি ছিল গ্রামে। নদীভাঙনের কারণে শহরে চলে আসি। গ্রামের কবিরাজের কাছে চিকিৎসা করিয়েও কোনো ফল পাইনি।
চোখের আইরিশ বা কালো পর্দার পেছনে স্বচ্ছ ও পরিষ্কার কাচের মতো যে বস্তু থাকে তাকে লেন্স বলে। আলোকরশ্মি এই লেন্সের ভেতর দিয়ে চোখের পেছন দিকে স্নায়ুপর্দা বা রেটিনাতে পড়ে। তারপর আমরা কোনো জিনিস দেখতে পাই। যদি কোনো কারণে এই লেন্সটি অস্বচ্ছ বা ঘোলাটে হয়ে যায়, তখন তাকে ছানিপড়া বলা হয়। আলোকরশ্মি কোনো অস্বচ্ছ বস্তুর মধ্য দিয়ে প্রবেশ করতে পারে না। তাই ছানি পড়ে গেলে আলোকরশ্মি চোখের রেটিনাতে পৌঁছাতে পারে না। দৃষ্টিশক্তি আস্তে আস্তে কমে আসে। চিকিৎসা না করালে একসময় কিছুই দেখা যায় না।
পৃথিবীব্যাপী অন্ধত্বের চারটি প্রধান কারণের মধ্যে ছানি একটি। অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে কর্নিয়ার রোগ এবং গ্লুকোমা ও ডায়াবেটিসজনিত চোখের রোগ। আমাদের দেশে চোখে ছানিপড়া অন্ধত্বের একটি অন্যতম প্রধান কারণ। ছানির লক্ষণগুলো হলো দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে কমতে থাকে, প্রাথমিক অবস্থায় দূরের জিনিস ঝাপসা বা কুয়াশাচ্ছন্ন দেখা যায়, দৃষ্টিশক্তি কমতে কমতে চোখ দৃষ্টিহীন হয়ে যায় এবং লেন্স সাদা বা বাদামি হয়ে যায়।
ছানি প্রধানত দুই ধরনের জন্মগত ও বয়সজনিত। বিভিন্ন কারণে শিশু ছানি নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে, বা জন্ম পরপরই ছানি দেখা দিতে পারে। এ ধরনের ছানিকে জন্মগত ছানি বলে। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ জন্মগত ছানি সাধারণত বংশগত। বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজারে পাঁচ থেকে ছয়টি শিশু জন্মগত ছানি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। সাধারণত গর্ভকালীন রুবেলা ভাইরাস জ্বরে মা আক্রান্ত হলে, গর্ভকালীন মায়ের পুষ্টিহীনতা, ক্যালসিয়াম বা ভিটামিন ‘ডি’র অভাবে, স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ সেবন করলে এবং রেডিয়েশনের প্রভাবে শিশুদের জন্মগত ছানি হতে পারে। কোনো নবজাতক যদি ৩৫ সপ্তাহের আগে জন্মগ্রহণ করে এবং তার ওজন যদি দুই কেজি বা তার কম হয়, তাহলে তার অন্ধত্বের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়া চোখে আঘাত, কর্নিয়ার সংক্রমণ এবং ঘন ঘন চোখের প্রদাহের কারণেও শিশুর চোখে ছানি পড়তে পারে।
বয়সজনিত ছানিপড়া যেকোনো বয়সের মানুষের হতে পারে। তবে ৪০ বছর বয়সের পর থেকে চোখের ছানিপড়া বৃদ্ধি ও দৃষ্টিশক্তি কমতে থাকে। চোখের ছানিপড়া রোগ হতে পারে পুষ্টিহীনতার কারণে, আঘাতজনিত কারণে, রেডিয়েশনের প্রভাবে, বিভিন্ন রোগের প্রতিক্রিয়া যেমন চোখের প্রেশার বৃদ্ধিজনিত কারণে, ডায়াবেটিস রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে, কর্নিয়ার আলসার বা ঘায়ের কারণে, দৃষ্টিস্বল্পতা বা মাইওপিয়ার কারণে, রেটিনার পর্দার রোগ যেমন রেটিনাইসিস পিগমেনটোসা ও রেটিনাল ডিটাগমেন্ট, ইউভিআইটিস প্রভৃতি রোগের কারণে। বয়স ৬০-৭০ হলে ছানিপড়াটা খুব স্বাভবিক। তবে অনেকের বংশগত কারণে ৪০-৪৫ বছর বয়সেও ছানি পড়তে পারে। বয়স বেশি হলে ছোখের লেন্সের মধ্যে কিছু রাসায়নিক পরিবর্তন হয়, লেন্স অস্বচ্ছ বা ঘোলাটে হয়ে যায় এবং ছানি পড়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালের তথ্যানুযায়ী, দেশে প্রায় ১৩ লাখ শিশুর দৃষ্টিত্রুটি রয়েছে এবং প্রায় দেড় লাখের বেশি শিশু ক্ষীণদৃষ্টি সমস্যায় আক্রান্ত। ৮০ শতাংশের ক্ষেত্রেই অন্ধত্বের মূল কারণ চোখে ছানি পড়া। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছানি ও অন্যান্য কারণে দেশে দৃষ্টিহীন শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। শিশুর অন্ধত্ব শুধু বাংলাদেশেরই নয়, বৈশ্বিক শিশু স্বাস্থ্যের জন্য এক মারাত্মক সমস্যা। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের মানুষের অজ্ঞতা, চক্ষু বিশেষজ্ঞের স্বল্পতা এবং পুষ্টিহীনতা ও ছানিজনিত জটিলতায় দৃষ্টিহীন হচ্ছে শিশুরা। তবে সঠিক সময়ে চিকিৎসা দিলে অর্ধেকের বেশি শিশুর ক্ষেত্রে এসব সমস্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
গবেষণায়ও দেখা গেছে, দৃষ্টিহীন মানুষের ৮০ শতাংশ গ্রামে বাস করে, যাদের ৯০ ভাগ দরিদ্র। তাদের উন্নত চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ্য নেই। অন্যদিকে ৯০ ভাগ চক্ষু চিকিৎসক ও তাদের সহযোগীদের বসবাস শহরাঞ্চলে। বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ছাড়াও ১২টি শিশু অন্ধত্ব নিবারণ কেন্দ্র রয়েছে। ঢাকায় ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল এবং জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে অন্ধ রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। অরবিস ইন্টারন্যাশনাল ৯টি চক্ষু হাসপাতালের মাধ্যমে অন্ধত্ব নিবারণে কাজ করছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, পাহাড়তলী, ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার, দিনাজপুর, রংপুর, কুমিল্লা, সিলেট, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও চাঁদপুরে একটি করে অন্ধত্ব নিবারণ কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে।
জন্মের কয়েক সপ্তাহ পরই যদি শিশুর পূর্ণ ছানি দেখা দেয়, তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছানি অপারেশন করা উচিত। দেরিতে বা বেশি বয়সে ছানি অপারেশন করলে চোখ ভালো হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। বড়দের ক্ষেত্রে ছানি পড়ার জন্য ওষুধে কোনো উপকার হয় না, অপারেশনই এ রোগের একমাত্র চিকিৎসা।
চোখ একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, কিন্তু এ বিষয়ে সাধারণ মানুষ যথেষ্ট সচেতন নয়। চোখের কিছু রোগ শিশুরা জন্ম থেকে বহন করে আর কিছু রোগ জন্মের পর সৃষ্টি হয়। অনেক রোগ রয়েছে, যেক্ষেত্রে অভিভাবকরা একটু সতর্ক হলে অন্ধত্ব দূর হয়ে যায়। তাই জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই নজর রাখতে হবে শিশুর চোখে কোনো সমস্যা আছে কি না। ছয় মাস পর্যন্ত শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও ইলেক্ট্রনিক খেলনা ব্যবহার থেকেও শিশুর দূরে রাখতে হবে।
পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, চোখ ও চোখের দৃষ্টি ভালো রাখতে নিয়মিত কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ভিটামিনজাতীয় খাবার খেতে হবে। ভিটামিনের মধ্যে ‘এ’ চোখের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এছাড়া ভিটামিন ‘ই’ ও ‘সি’ দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শিশুদের ছয় মাস বয়স থেকে বুকের দুধের পাশাপাশি শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়াতে হবে। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি চোখের ক্ষতি করে। তাই সূর্যালোক থেকে দূরে রাখতে হবে। চোখ ভালো রাখতে প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে ঠাণ্ডা ও পরিষ্কার পানি দিয়ে চোখ ভালোভাবে ধুয়ে ঘুমানো উত্তম।
মানবদেহের অমূল্য সম্পদ চোখকে কোনোভাবেই অবহেলা করা ঠিক নয়। শিশুদের রাতকানা ও অন্ধত্ব আমাদের কাম্য নয়। গর্ভবতী মাকে অনাগত শিশুর সুস্থতার জন্য গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। শিশুদের মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি ভিটামিন ‘এ’ ও অন্যান্য পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার প্রতিদিন বেশি করে খাওয়াতে হবে এবং সময়মতো চিকিৎসকের পরমর্শ নিতে হবে। দেশের প্রতিটি শিশু তীক্ষè দৃষ্টিশক্তি নিয়ে বেঁচে থাকবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
পিআইডি প্রবন্ধ