নিজস্ব প্রতিবেদক: নানা কড়াকড়ি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ এখন সঞ্চয়পত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ফলে সঞ্চয়পত্র ভাঙানো বেড়েই চলছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ঋণাত্মক হয়ে গেছে। এ পাঁচ মাসে নিট বিক্রি কমেছে এক হাজার ৬১০ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। সঞ্চয় পরিদপ্তরের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানা কড়াকড়িতে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ধস নেমেছে। বিনিয়োগসীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। তাই মেয়াদ শেষে অনেকেই আর নতুন বিনিয়োগ করতে পারছেন না। ফলে এ খাতে বিনিয়োগ কমছে। এছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ খুব বেশি মুনাফা পাচ্ছে না। এটাও সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমার বড় কারণ।
তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বরে মোট ৬ হাজার ৮৮৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। আসল পরিশোধ করা হয়েছে ৭ হাজার ৮৬৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ফলে নিট বিক্রি কমেছে ৯৭৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।
এছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ৩৪ হাজার ৯৩৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর বিপরীতে মূল পরিশোধ হয়েছে ৩৬ হাজার ৫৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে প্রথম পাঁচ মাসে নিট ঋণ কমেছে এক হাজার ৬১০ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।
আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, সেটিকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা থাকে। সরকার তা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। এ কারণে অর্থনীতির ভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কড়াকড়ির কারণেই মূলত সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ভাটা পড়েছে। এছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ খুব বেশি মুনাফা পাচ্ছে না। এটাও সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমার বড় কারণ।
ঋণের বোঝা কমাতে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়া কমিয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে টিআইএন এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাধ্যতামূলক হওয়ায় অনেকেই সঞ্চয়পত্রে আগের মতো বিনিয়োগ করতে পারছেন না। এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের মতে, আগে কালো টাকা সঞ্চয়পত্র খাতে বিনিয়োগ হতো। এখন সেটা হচ্ছে না। ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে মন্দা দেখা দিয়েছে।
সর্বশেষ চলতি অর্থবছর ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থাকলে রিটার্নের সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর আগে গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব রকম সঞ্চয়পত্রের সুদহার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। তার আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে আনা হয়। এছাড়া ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। এছাড়া দুর্নীতি বা কালো টাকায় সঞ্চয়পত্র কেনা বন্ধে ক্রেতার তথ্যের একটি ডেটাবেস তৈরি হয়েছে। এসব কড়াকড়ির প্রভাবে বর্তমানে সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে নেমেছে।
বর্তমানে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে। পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১ দশমিক ৫২, পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ৭৬, পাঁচ বছর মেয়াদি মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ২৮, তিন বছর মেয়াদি ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ।
কয়েক দফায় সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো হলেও এখনো তা ব্যাংকের তুলনায় বেশি। ৪৫০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত হিসেবে ব্যাংক আমানতের সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের সুদহারের ব্যবধান কমানোর পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বাংলাদেশ ব্যাংকও বিষয়টি বিবেচনা করার আশ্বাস দিয়েছে সংস্থাটিকে।