Print Date & Time : 26 June 2025 Thursday 10:42 pm

সঞ্চয়পত্রের কাঠামো ও সুদহার সংস্কারের পরামর্শ আইএমএফের

সঞ্চয়পত্র থেকে লাগামহীন ঋণ নিচ্ছে সরকার। এ প্রবণতা ঝুঁকি ও বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করছে অর্থনীতিতে, নিয়মিতই যার সমালোচনা করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারপরও সরকার এ বিষয়ে নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। সঞ্চয়পত্র থেকে ঢালাও ঋণ নেওয়া এবং অর্থনীতিতে এর সম্ভাব্য প্রভাব বিশ্লেষণ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন তথ্য নিয়ে অনুসন্ধান করেছে শেয়ার বিজ। এ নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ ছাপা হচ্ছে শেষ পর্ব

শেখ আবু তালেব: বিদ্যমান সুদহার বাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে সঞ্চয়পত্রের কাঠামো পুনর্বিন্যাস করাসহ আমূল সংস্কারে বাংলাদেশকে একগুচ্ছ পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে কীভাবে সঞ্চয়পত্রের অতিরিক্ত ঋণ প্রভাব ফেলতে পারে তাও তুলে ধরা হয়েছে। সবার জন্য সঞ্চয়পত্র সুবিধা বন্ধ ও সংখ্যা কমানো, সুবিধাভোগীর তথ্যভাণ্ডার তৈরি এবং বাজেটে এ খাত থেকে ঋণ নেওয়া বন্ধ করে আর্থিক সুবিধা সরাসরি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এজন্য উদাহরণ হিসেবে পাকিস্তানের নেওয়া কয়েকটি পদক্ষেপের সফলতার কথা তুলে ধরেছে আইএমএফ।
গত ছয় অর্থবছর ধরেই সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা অস্বাভাবিক আকারে বেড়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল ৭৭০ কোটি টাকা। পাঁচ বছর পরে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬৭ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১ হাজার ৬০০ কোটিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে গত ১০ মাসে (জুলাই ’১৭ থেকে এপ্রিল ’১৮) বিক্রি হয়েছে ৬৬ হাজার ৬৬২ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
এতে সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা হুমকির মধ্যে পড়েছে, যার নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতির অন্যান্য খাতেও পড়তে শুরু করেছে। অর্থনীতির সূচকগুলো স্বাভাবিক আচরণ করছে না। ব্যাংক খাতে আমানত সংকটে ভুগছে। পুঁজিবাজার উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকার। গত এক বছরে দুবার সুদের হার পরিবর্তন হয়েছে ব্যাংক খাতে। আগামী জুলাই থেকে নতুন সুদহার কার্যকর হতে পারে। এভাবে অর্থনীতির শৃঙ্খলা বিচ্যুতি হচ্ছে বলে বিশেষ এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে আইএমএফ। সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় থেকেই পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ঋণ ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হচ্ছে।
সঞ্চয়পত্র থেকে বাংলাদেশ সরকারের মতো অস্বাভাবিক ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছিল সার্কভুক্ত দেশ পাকিস্তানেও। তখন দেশটিতে মূল্যস্ফীতিও বেড়ে গিয়েছিল। আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে দেশটির নেওয়া পদক্ষেপগুলো পরে সফলতা এনেছে। আইএমএফের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংস্কারের অংশ হিসেবে সঞ্চয়পত্রের সংখ্যা ৩০টি থেকে কমিয়ে আটটিতে নামিয়ে এনেছে পাকিস্তান। এছাড়া সুবিধাভোগি শ্রেণির সংখ্যা কমিয়ে এনেছে। আগে সব শ্রেণি ও পেশার লোকজনের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিকরা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারত। এখন শুধু ব্যক্তিশ্রেণির লোকজন বিনিয়োগ করতে পারে। আগে নির্ধারিত কোনো সীমা না থাকায় বর্তমানে সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
সুদহার কমিয়ে অন্যান্য আর্থিক খাতের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে। আগে সুদহারের ব্যবধান অনেক বেশি থাকলেও এখন বাজার ওঠানামার সঙ্গে সমন্বয় করা হয়। উš§ুক্ত বাজার অর্থনীতির সঙ্গে প্রয়োজন হলেই সুদহার নির্ধারণ করা হয়। সরকারের সেকেন্ডারি সিকিউরিটিজ মার্কেটের পণ্য ট্রেজারি বিল ও ট্রেজারি বন্ডের নিলামে ব্যক্তিরাও অংশগ্রহণ করতে পারে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ৭, ১৪, ৩০, ৯১ ও ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিল ও ট্রেজারি বন্ডের নিলামে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকগুলো অংশগ্রহণ করতে পারে। বাংলাদেশে স্বল্প মেয়াদে বিনিয়োগের জন্য ব্যক্তি খাতের কোনো খাত নেই। ব্যাংকে সর্বনি¤œ তিন মাসের জন্য আমানত রাখতে পারে ব্যক্তিরা। পাকিস্তানে ব্যক্তিগতভাবে এ খাতে বিনিয়োগ করার সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
জাতীয় বাজেটে অভ্যন্তরীণ ঋণের উৎস হিসেবে সঞ্চয়পত্রকে বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। সংস্থাটি বলছে, বিশেষ জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সুবিধা দিতে চাইলে বাজেটে বরাদ্দ দিয়ে সরাসরি দেওয়া যেতে পারে। সামাজিক সুরক্ষার অংশ হিসেবে তা করা যেতে পারে। এটি সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছা। সঞ্চয়পত্রের সুবিধাভোগী নির্ধারণ করার জন্য একটি তথ্যভাণ্ডার করতে হবে। এখন বাংলাদেশে কারা সঞ্চয়পত্র কিনছে তার কোনো তথ্যভাণ্ডার নেই।
জাতীয় পরিচয়পত্র ও কর নিবন্ধনের সঙ্গে লিংকআপ করে এই পদ্ধতি নিতে পারে বাংলাদেশ। পাকিস্তানও তা-ই করেছে। এতে তারা সফল হয়েছে। সবার জন্য সঞ্চয়পত্র নয় বলে সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান। বিধবা, অসহায় ও ৬০ বছরের অধিক বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ সুদের সঞ্চয়পত্রের প্রচলন শুরু করে। অন্যদিকে বাংলাদেশে সঞ্চয়পত্র সবার জন্য উš§ুক্ত।
সঞ্চয়পত্র বিক্রির সঙ্গে পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে ১০ শতাংশে উঠেছিল। পরে নিয়ন্ত্রণ করায় মূল্যস্ফীতি ২০১১ সালে যেখানে দশ শতাংশে ছিল, ২০১৭ সালে তা কমে ছয় শতাংশের নিচে নামে। বাংলাদেশেও সঞ্চয়পত্রের বিক্রির সঙ্গে মূল্যস্ফীতি ওঠানামা করে। বিক্রি বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়ে, বিক্রি কমলে মূল্যস্ফীতি নিচের দিকে নামতে থাকে।
পাকিস্তানে বর্তমানে সব ব্যাংক সঞ্চয়পত্র বিক্রি করতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কমিশন এজেন্ট হিসেবে। এক্ষেত্রে দেশটি যুক্তি দেখিয়েছে, গ্রাহকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখে ব্যাংকগুলো। তাদের হিসাব থাকায় সব ধরনের সেবা দিতে পারে। এতে ব্যাংকের সঙ্গে গ্রাহকের সম্পর্কের উন্নয়ন হয়। গ্রাহকরা অর্থনীতির বিভিন্ন সুবিধা তাদের কাছ থেকে জানতে পারে।
কর নিবন্ধন থাকা সঞ্চয়পত্রভোগীদের মুনাফা বা সুদের ওপর ১০ শতাংশ কর ও নিবন্ধনহীনদের কাছ থেকে ২০ শতাংশ কর নেওয়ার প্রথা চালু করেছে পাকিস্তান। এতে সঞ্চয়পত্রের সঙ্গে আর্থিক খাতের অন্যান্য সূচকের সমন্বয় থাকায় সরকারের সেকেন্ডারি মার্কেটে তারল্য সরবরাহ বেড়েছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, সঞ্চয়পত্রে কাঠামোগত সংস্কারের কথা আমরা বলে আসছি। দ্রুতই সরকারের এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। সুবিধাভোগীদের তথ্যভাণ্ডার এখন সহজেই করা যেতে পারে। সেইসঙ্গে অর্থের উৎস দেখা দরকার সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থার।
বাংলাদেশে বর্তমানে ১৭ ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে। ডাকঘরেই তিনটি আলাদা হিসাবেও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা যায়। তা ধরলে সংখ্যা ২০-এ উন্নীত হয়। এর মধ্যে প্রবাসীদের জন্য রয়েছে তিনটি। সামাজিক নিরাপত্তার অংশ হিসেবে বিশেষ কিছু জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সুবিধা দিতে ব্যাংকের চেয়ে উচ্চ সুদে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সুবিধা দেওয়া হয়। বয়োজ্যেষ্ঠ, প্রতিবন্ধী ও অবসরে যাওয়া ব্যক্তিরা এর অন্তর্ভুক্ত। এজন্য ব্যক্তিগতভাবে একজনের সর্বোচ্চ বিনিয়োগ সীমা ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকা এবং পারিবারিকভাবে সর্বোচ্চ ৬০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা যাবে সঞ্চয়পত্রে। ব্যক্তি ও পারিবারিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সীমা নির্ধারিত থাকলেও প্রতি বছর কী পরিমাণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি করা হবে তার কোনো সীমা নেই। ফলে কেউ চাইলেই এ খাতে বিনিয়োগ করতে পারে। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত না থাকায় চাহিদা মোতাবেক বিক্রি হয় সঞ্চয়পত্র।
প্রসঙ্গত, ব্যাংক খাত থেকে যেখানে সরকার দুই দশমিক ৪৯ থেকে সাড়ে আট শতাংশ টাকার সুুদে ঋণ নিতে পারে সরকার, অপরদিকে জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিলে ১০ থেকে ১২ শতাংশ সুদ দিতে হয়। দুই বছর আগে এই হার ছিল সর্বোচ্চ ১৪ শতাংশ পর্যন্ত।