সঞ্চয়পত্রে নির্ভরতা দীর্ঘ মেয়াদে প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করবে

সঞ্চয়পত্র থেকে লাগামহীন ঋণ নিচ্ছে সরকার। এ প্রবণতা ঝুঁকি ও বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করছে অর্থনীতিতে, নিয়মিতই যার সমালোচনা করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারপরও সরকার এ বিষয়ে নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। সঞ্চয়পত্র থেকে ঢালাও ঋণ নেওয়া এবং অর্থনীতিতে এর সম্ভাব্য প্রভাব বিশ্লেষণ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন তথ্য নিয়ে অনুসন্ধান করেছে শেয়ার বিজ। এ নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ ছাপা হচ্ছে দ্বিতীয় পর্ব

শেখ আবু তালেব: নিরাপদ ও সহজে উচ্চহারে সুদ পাওয়ায় ব্যাংক ছেড়ে জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ শুরু করেছেন বিত্তশালীরা। এ প্রবণতা চলমান থাকলে দীর্ঘ মেয়াদে আমানত সংকটে ভুগবে ব্যাংকগুলো। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংক এ সমস্যায় বেশি পড়বে। ইতোমধ্যে তারল্য সংকটে গত মার্চের চেয়ে এপ্রিলে ৪১২ কোটি টাকার বিনিয়োগ কমেছে ব্যাংক খাতে। চাহিদা অনুযায়ী বিনিয়োগের অর্থ না পেয়ে বেসরকারি বিনিয়োগ কমতে শুরু করবে। নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে। মুনাফা ধরে রাখতে ব্যাংকগুলো উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ খাতে ঋণ বিতরণ করবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে উচ্চ সুদে লাগামহীন ঋণ নেওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে আইএমএফের প্রতিবেদনে এমন শঙ্কার কথা বলা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো পর্যন্ত সরকারকে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে লাগাম টানতে অনুরোধ করে আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও অর্থ মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে লিখিতভাবে জানিয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাজেটের আগে সংস্কারের কথা বললেও নতুন বাজেটে কিছুই বলেননি। অবশ্য আইএমএফের শঙ্কার কিছুটা প্রভাব ইতোমধ্যেই ধরা পড়েছে আর্থিক খাতে।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, আইএমএফের সতর্কবাণীর যৌক্তিকতা আছে। এর মধ্যে রয়েছে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সমস্যা, সুদ ব্যয় বৃদ্ধি ও ব্যাংকবিমুখ হতে পারেন আমানতকারীরা। এখন সঞ্চয়পত্রে নামে-বেনামে বিত্তশালীরাও এ সুবিধা নিচ্ছেন। ভারত ইতোমধ্যে বিষয়টি একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে এসেছে। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নীতিমালায় সংস্কার আনতে আমরা বারবার বলে আসছি। জাতীয় পরিচয়পত্র ও কর নিবন্ধন নম্বরের মাধ্যমেও একটি প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসার সময় হয়েছে।
আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের মধ্যবর্তী সময়ে হঠাৎ করেই জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে উল্লম্ফন শুরু হয়। এ সময় ব্যাংকগুলোয় আমানত ও ঋণ বিতরণের প্রবৃদ্ধিতে বিস্তর ফারাক তৈরি হয়। মূলত রাজনৈতিক উত্তেজনায় বিনিয়োগ পরিস্থিতি নেতিবাচক হওয়ায় মানুষ সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকতে শুরু করে। কিন্তু বিনিয়োগ কিছুটা বাড়লেও সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেনি। পাঁচ বছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়েছে ৬৭ গুণ।
সূত্র জানিয়েছে, আশানুরূপ বিনিয়োগ না বাড়ায় ব্যাংকগুলোতে জমতে থাকে অলস অর্থের পাহাড়। এক পর্যায়ে ব্যাংকগুলো এক অঙ্কে অর্থাৎ সাত শতাংশে নামিয়ে আনে আমানতের বিপরীতে সুদহার। পাশাপাশি কমায় ঋণের সুদহার। সুদহার কমে যাওয়ায় ব্যাংকবিমুখ হন গ্রাহকরা। সর্বোচ্চ ১৪ শতাংশ সুদ পাওয়ায় জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ শুরু করেন আমানতকারীরা।
এমন সময় রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকে পাঁচ হাজার কোটি ও বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংকে বড় অঙ্কের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে। এতে ফারমার্স ব্যাংক অস্তিত্ব রক্ষার সংকটে পড়ে। বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে মানুষ ব্যাংকের প্রতি আস্থা হারিয়ে আমানত তুলে নিতে থাকে। এতে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রবণতা শুরু হয়। শিল্পায়নের গতি শ্লথ হয়।
অপরদিকে জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়তে থাকে। বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় অর্থনীতিবিদদের ক্রমাগত সমালোচনা ঠেকাতে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে ব্যাংকগুলোকে বেশি ঋণ দেওয়ার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়। এ সুযোগে কয়েকটি ব্যাংকের মাধ্যমে কিছু ব্যবসায়ী অস্বাভাবিক ঋণ নিতে শুরু করে। সুদহার এক অঙ্কে নামায় অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে ব্যাংকগুলো। আগ্রাসী ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকিংয়ের কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে বেসরকারি খাতের নতুন প্রজšে§র ফারমার্স ব্যাংক। এতে এক পর্যায়ে তারল্য সংকটে ভুগতে শুরু করে ১০ থেকে ১২ ব্যাংক।
ফলশ্রুতিতে ব্যাংক খাতে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে থাকা এক লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকার উদ্বৃত্ত তারল্য ৮৬ হাজার কোটিতে নেমে আসে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ বিতরণের প্রাক্কলন অতিক্রম করে। আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের ধকল সামলাতে তারল্য সংকটে ভুগতে থাকা ব্যাংকগুলোকে মুদ্রানীতির বাইরে গিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সিআরআর (বাংলাদেশ ব্যাংকে বাণিজ্যিক ব্যাংকে দৈনিক নগদ জমার হার) এক শতাংশ কমিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া ঋণ-আমানতের অনুপাত প্রচলিত ব্যাংকের জন্য দেড় শতাংশ ও ইসলামি ব্যাংকগুলোর জন্য এক শতাংশ বাড়িয়ে দেয়।
ফলে ব্যাংকগুলোকে আর্থিক দিক ঠিক রাখতে নতুন করে আমানত সংগ্রহে নামতে হয়। ফের ঋণ সুদহার বেড়ে যায়। বিষয়টি বিশ্লেষণ করে আইএমএফ বলছে, জাতীয় সঞ্চয়পত্রে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এ অবস্থা হয়েছে। সরকারের মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন করতে সমস্যায় পড়েছে। যার প্রভাব পুরো আর্থিক খাতে পড়তে শুরু করবে।
আইএমএফের মতে, সঞ্চয়পত্রে এখন বিত্তশালীরা বিনিয়োগ করছেন। তাদের সংখ্যাই বেশি। এভাবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়তে থাকলে সবাই ব্যাংকবিমুখ হবেন। এতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতেও আমানত সরবরাহ কমে যাবে। বিনিয়োগের অর্থ পাবে না ব্যাংক। আর্থিক ব্যবস্থাপনা চ্যালেঞ্জের মুখে নিপতিত হবে। বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না।
অপরদিকে সরকার আগামী অর্থবছরের (২০১৮-১৯) প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অতিরিক্ত এক লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা লাগবে। বিশাল এই অর্থের জোগান নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। আইএমএফের শঙ্কা প্রকাশের কিছুটা ছাপ ইতোমধ্যেই অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে। রাজনৈতিক সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ায় এখনও অনেক বড় প্রতিষ্ঠান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অবদান রাখছে না। নতুন করে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করছে না। শিল্পায়নে বিনিয়োগ কমায় প্রভাব পড়েছে কর্মসংস্থানে। যার ব্যাখ্যা আগামী অর্থবছরের (২০১৮-১৯) প্রস্তাবিত বাজেটেও দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
প্রসঙ্গত, বাজেট বাস্তবায়ন ও প্রয়োজন হলেই দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস হিসেবে ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত খাতের বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ নেয় সরকার। সামাজিক নিরাপত্তার অংশ হিসেবে বিশেষ কিছু জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ আর্থিক সুবিধা দিতে ব্যাংকের চেয়ে উচ্চ সুদের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ব্যবস্থা করে রাষ্ট্র। স্বল্প আয়, বয়োজ্যেষ্ঠ, প্রতিবন্ধী ও অবসরে যাওয়া ব্যক্তিরা এর অন্তর্ভুক্ত। এজন্য ব্যক্তিগতভাবে একজন সর্বোচ্চ বিনিয়োগসীমা ৩০ লাখ ও পারিবারিকভাবে সর্বোচ্চ ৬০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে পারবেন সঞ্চয়পত্রে। ব্যাংক খাত থেকে যেখানে সরকার দুই দশমিক ৪৯ থেকে সাড়ে আট শতাংশ টাকার সুুদে ঋণ নিতে পারে। অপরদিকে জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিলে ১০ থেকে ১২ শতাংশ সুদ দিতে হয়। দুবছর আগে এ হার ছিল সর্বোচ্চ ১৪ শতাংশ পর্যন্ত।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০