মো. আল-মামুন: আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ। প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার একটি অমিত সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। দারিদ্র্য, নদীভাঙন ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এবং কর্মসংস্থানের খোঁজে গ্রাম থেকে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মানুষ আসছে রাজধানী ঢাকায়। তবে এই ঢাকা একটি আজব শহর। এই শহরে নানারকম দালানকোঠার মতো মানুষের মনগুলোও নানা রঙের হয়ে থাকে। গ্রাম থেকে অনেকেই নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য এই শহরকে বেছে নেয়। ব্যস্ত এই শহরে কেউ যেন কারও নয়। এই শহরে ঘর থেকে বের হলেই প্রতিনিয়ত একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার দেখা মেলে, আর তা হলো পথশিশু। সাধারণত তাদের দেখা মেলে রাস্তাঘাট, রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল, লঞ্চ টার্মিনাল কিংবা পার্কে। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, তাদের কেউ বলে রাস্তার শিশু, কেউ বলে টোকাই, আবার কোনো কোনো সাহিত্যমনা আদর করে তাদের নাম দিয়েছেন পথশিশু। তাদের নেই সবুজ মাঠ, নেই নীল আকাশ, আছে শুধু নির্মমতা আর বুকভরা হাহাকার।
বলা হয়ে থাকে, আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই তাদের সঠিকভাবে পরিচর্যা করাটাও অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু তাদের মধ্যে যারা রাস্তায় জীবনযাপন করে, তারা পরিচিতি পায় পথশিশু হিসেবে। পথশিশুদের বেড়ে ওঠার মধ্যে তারা পরিচিত হয় নতুন অনেক অভিজ্ঞতার সঙ্গে। আমাদের দেশে পথশিশুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এসব পথশিশু সাধারণত রাস্তার জিনিসপত্র কুড়িয়ে বেঁচে থাকে। বেশিরভাগ পথশিশুর বাবা-মা নেই। অনেক সময় তাদের বাবা-মা থাকলেও তাদের পরিচয় পাওয়া যায় না। আবার অনেকের বাবা-মা আছে, কিন্তু যোগাযোগ নেই। তাদের জন্ম রাস্তায়, রাস্তায় তাদের জীবন কাটে এবং অবশেষে রাস্তায় তাদের মৃত্যু হয়। এসব শিশু সাধারণত দারিদ্র্য, দাম্পত্য কলহ, বিয়েবিচ্ছেদ, পরিবার থেকে পলায়ন ও যৌন নিপীড়নের কারণে রাস্তায় নিক্ষিপ্ত হয়। কেউ তাদের দেখাশোনা করে না। শুরু হয় তাদের অবহেলিত কষ্টের জীবন। এসব পথশিশুর না আছে কোনো পরিবার, না আছে কোনো স্বপ্ন। তারা জানে না তাদের ভবিষ্যৎ কী। তারপরও তারা বেঁচে আছে। পথশিশুদের একদিকে অভাবের তাড়না, অন্যদিকে অভিভাবকহীনতা। এই সুযোগে তারা জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন ধরনের অপরাধে, জড়িয়ে পড়ছে নেশার জগতে। রাস্তার পাশে গ্লুটার গাম বা আটা দিয়ে প্রকাশ্যে ডেন্ডি নামের নেশায় আসক্ত হচ্ছে তারা। ক্ষতিকারক ডেন্ডি এক ভয়ংকর নেশা। তৃণমূল অসহায় পথশিশুরা ছোট নেশার জগৎ থেকে হয়ে উঠছে নেশার জগতের মাফিয়া; করছে অপরাধ, গড়ে তুলছে কিশোর গ্যাং। পথশিশু থেকে ডেন্ডিখোর, তারপর কিশোর গ্যাং, তারপর হয়ে ওঠে অন্ধকার জগতের রাজা। কখনও মাদক, কখনও অস্ত্র হাতে তুলতে দেখা যায় তাদের। যে বয়সে তাদের হাতে থাকার কথা বই-খাতা, থাকার কথা পরিবারের বন্ধন সে বয়সে কেউ কেউ কাঁধে তুলে নিচ্ছে প্লাস্টিকের বস্তা, আবার কেউবা হাতে তুলে নিচ্ছে অস্ত্র। সমাজের আর ১০টা সাধারণ শিশুর মতো তাদের জীবন নয়।
ধারণা করা হয়, দেশে ছয় লাখের বেশি পথশিশু রয়েছে এবং তাদের ৭৫ শতাংশ রাজধানীতে বসবাস করে। মানব উন্নয়ন সূচকে ১৩৩তম স্থানে থাকা একটি দেশ, যেখানে জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, সেখানে এই শিশুরা সামাজিক স্তরগুলোর মধ্যে সর্বনিন্ম স্তরের প্রতিনিধিত্ব করে। দেশের জনসংখ্যা এখন বেড়েছে, আর পথশিশুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে আনুমানিক ৪০ লাখ। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পথশিশুদের ৫১ ভাগ ‘অশ্লীল কথার শিকার’ হয়। শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয় ২০ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয় মেয়েশিশু। ১৪ দশমিক পাঁচ শতাংশ পথশিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়; আর মেয়ে পথশিশুদের মধ্যে ৪৬ ভাগ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট নামের একটি এনজিওর তথ্যমতে, পথশিশুদের কেউ কেউ মাদকাসক্ত হয়ে রাস্তায়ই মারা যায়। কেউ কেউ বিভিন্ন চক্রের মাধ্যমে পাচার হয়ে যায়। যারা পাচারের শিকার হয়, তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি হয়। নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয় তারা। যারা মেয়ে, তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। কোনো কোনো গ্যাং তাদের যৌনকর্মী হতে বাধ্য করে। এছাড়া অপরাধী চক্রগুলো তাদের মাদকসহ নানা অবৈধ ব্যবসায় কাজে লাগায়। তারা আসলে অপরাধী নয়, তারা অপরাধের শিকার হয়। সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক এনহান্সমেন্ট প্রোগ্রাম নামের একটি সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পথশিশুদের প্রায় ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত, ৪১ শতাংশ শিশুর ঘুমানোর কোনো বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ শিশু গোসল করতে পারে না, ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে, ৫৪ শতাংশ অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই এবং ৭৫ শতাংশ শিশু অসুস্থ হলে ডাক্তারের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারে না।
সামাজিক সব অধিকার থেকে বঞ্চিত-উপেক্ষিত এসব শিশুকে পথে পথে ঘুরতে হয় কাজের সন্ধানে। পেটের দায়ে দিনমজুরি, বাসের হেলপারি, কারখানা শ্রমিকের কাজ, রিকশা চালানো, চা-সিগারেট বিক্রি, টোকাইয়ের কাজ, ইট ভাঙাÑকত কাজই না তারা করে। আসলে এই পথশিশুদের জীবন-যাপন অনেক জটিল। বেঁচে থাকার তাগিদে অনেকে ভিক্ষাবৃত্তিও বেছে নেয়। আর ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ থেকে তারা নানা জিনিস সংগ্রহ করে বিক্রির জন্য। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে যে, পথশিশুদের ৮২ শতাংশই নানা ধরনের পেটের অসুখে আক্রান্ত। এই অসুখের পেছনে অস্বাস্থ্যকর খাবার দায়ী। ক্ষুধার জ্বালায় তারা ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া খাবার খেতেও দ্বিধাবোধ করে না। পথশিশুদের ক্ষুধার যন্ত্রণা তাদের থেকে আর কারও বেশি জানা নেই। নোংরা পরিবেশে থাকার কারণে তাদের মধ্যে চর্মরোগের হারও অনেক বেশি। পথশিশুদের প্রায় ৬১ শতাংশই কোনো না কোনো চর্মরোগে আক্রান্ত। পথশিশুদের মধ্যে নানা ধরনের সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ার হারও তুলনামূলকভাবে বেশি।
দেশজুড়ে সেমিনার, সভা-সমাবেশ, পথযাত্রা ও ওয়ার্কশপ করে দেখানো হয়, শিশুদের জন্য অনেক কিছু করা হচ্ছে। তাদের আর্থিক, সামাজিক, শারীরিক, মানসিক, রাষ্ট্রীয় প্রভৃতি বিষয়ে যথোপযুক্ত নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা শোনা যায়। কিন্তু পথশিশুদের বেলায় তার কানাকড়িও করা হয় না। পথশিশুরা বাবা-মায়ের আদর-সোহাগ থেকে বঞ্চিত। আদর-সোহাগ কী, তারা জানে না। জীবনের প্রতি তাদের মায়া না থাকায় তারা বিপথগামী হয়ে উঠছে। সমাজে বাবা-মায়ের আদরের অন্যান্য সন্তানের মতো শিশুদের যে সময় স্কুলে যাওয়ার কথা, সে সময়ে তারা অনাদর ও অবহেলায় রাস্তায়, ফুটপাতে, স্টেশনে ও পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়ায়। সবকিছু থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তারা একসময় হয়ে ওঠে অপরাধী। আদর ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত এই শিশুরাও সমাজের সম্পদ। তাদের যথাযথ আদর-ভালোবাসা দিয়ে প্রতিপালন করলে তারা সমাজে বিদ্বেষী না হয়ে সমাজের বন্ধু হতে পারে। ঢাকাসহ সারাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসব উপেক্ষিত পথশিশুকে যথাযথভাবে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এসব শিশুরও অধিকার রয়েছে আট-দশটা সাধারণ শিশুর মতো বেড়ে ওঠার। উপযুক্ত পুনর্বাসন, শিক্ষা ও মৌলিক অধিকার পেলে তারাও হয়ে উঠবে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী, দেশবরেণ্য সাহিত্যিক, সমাজসেবক প্রভৃতি। এতে এসব পথশিশুর জীবনপথ পরিবর্তনের পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রও লাভবান হবে।
ঢাকাসহ সারাদেশে পথশিশুদের নিয়ে অনেক বেসরকারি সংগঠন কাজ করে। কেউ খাবার দেয়, কেউ পোশাক দেয়, কেউ দেয় শিক্ষা, কেউ আবার তাদের বিনোদনের ব্যবস্থাও করে। কিন্তু দিনশেষে তাদের পথেই ফিরে যেতে হয়। পথশিশুদের নিয়ে শহরে অনেক বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ আছে। সরকারি কিছু উদ্যোগও আছে। কিন্তু কোনো উদ্যোগই টেকসই নয়। তাদের দরকার স্থায়ী থাকার জায়গা, শিক্ষা ও খাবারের ব্যবস্থা। তাদের অন্যান্য শিশুর মতো জীবন-যাপন করার সুযোগ করে দিতে হবে। আজকের শিশু যেহেতু আগামী দিনের কর্ণধার, তাই পথশিশুর অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। পথশিশুর শৈশব কেড়ে নিয়ে তাদের অনিশ্চয়তায় ফেলে দেয়া কখনও ঠিক হবে না। প্রতিটি শিশুর মধ্যে রয়েছে সুপ্ত প্রতিভা। তেমনিভাবে সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের ভেতরও রয়েছে আলাদা একটি জগৎ। তাদের চিন্তাধারাও আলাদা আলাদা। তাদেরও স্বপ্ন আছে। আজকে যে শিশুটি হেসে-খেলে বড় হচ্ছে, কাল সে-ই হবে এ দেশের প্রধানমন্ত্রী, জাতির অভিভাবক। তাই তো কবি গোলাম মোস্তফা বলেছেন, ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।’ সুতরাং এ দেশ ও জাতির মঙ্গলের কথা মাথায় রেখেই আমাদের শিশুদের প্রতি যতœশীল হতে হবে। আমাদের দায়িত্ব হবে প্রত্যেকটি শিশুকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা। প্রয়োজনীয় শারীরিক ও মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের নীতিবান, সৎ, কর্মদক্ষ ও সচেতন নাগরিক তথা রাষ্ট্রের মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা।
শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়