সত্তরেও সপ্রাণ

যে কোনো উদ্যোগের শুরুতে অনেক বাধা-বিপত্তি আসে। এসব গায়ে না মেখে লেগে থাকলে সফল হওয়া যায়। যারা সফল হন তাদের অনুসরণ করলে আরও নতুন উদ্যোগ শুরু হয়। নানা খাতের সেসব সফল উদ্যোক্তা নিয়ে আমাদের ধারাবাহিক আয়োজন

এমএস রুকন, গাজীপুর: আজিজুল হক মুন্সীর বয়স ৭০। পেশায় মৌচাষি। এ বয়সে প্রতিদিন ১৫-২০ কিলোমিটার পথ হেঁটে মধু সংগ্রহ করেন। এ কাজ করেই সংসার চলে তার।

এ পর্যায়ে আসতে তাকে দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। আজিজুল হকের বাড়ি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের চকপাড়া গ্রামে। তিনি ১৯৮৬ সালে মৌমাছি নিয়ে কাজ শুরু করেন। তখন সরিষা ক্ষেতে মৌচাষের চেষ্টা করেন। সরিষা ক্ষেতে মৌচাষের কথা ছড়িয়ে পড়লে তাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত গ্রামের লোকজন। ফসল নষ্ট হয়ে যাবে, এ কারণে অনেক কৃষক তাদের জমিতে মধুর বাক্স বসাতে দিতেন না। এ প্রসঙ্গে আজিজুল হক বলেন, অনেকে বাক্স নিয়ে টানা-হেঁচড়া করতেন। কেউ কেউ বাক্স বসানোর জন্য টাকা দাবি করতেন। ধীরে ধীরে পাল্টাতে থাকে সেইসব দুঃসহ দিন। বাংলাদেশের সরিষা ক্ষেত মৌচাষের জন্য উপযোগী এটা উপলব্ধি করতে শুরু করেন অনেক কৃষক।

এভাবে চলতে থাকে কয়েক বছর। কিন্তু প্রশিক্ষণের অভাবে লাভের মুখ দেখতে পাননি বেশ কয়েক বছর। পরে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রশিকা কেন্দ্র থেকে মৌচাষের ওপর ১০ দিনের প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে সেখান থেকেই ১০ হাজার টাকা ঋণ নেন। শুরু করেন সেরেনা মৌমাছি চাষ। পরে নজর দেন মেলিফেরা জাতের প্রতি।

১৬ বছর পর ২০০২ সালে প্রথম লাভের মুখ দেখেন। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশে কয়েক ধরনের মৌমাছি চাষ হয়। এর মধ্যে ডরসেটা জাতের মৌমাছি ঘরের কোনায় বা খোলা জায়গায় চাষ করা যায়। বর্তমানে চাষ উপযোগী তিন প্রজাতির মৌমাছি রয়েছে মেলিফেরা, ফ্লোরিয়া ও সেরেনা।

আশপাশের আবাদি জমির তুলনায় মধুর বাক্স বসানো জমিতে সরিষার ফলন ভালো হয়েছে। সেসব জমিতে প্রায় ২০-৩০ শতাংশ বেশি ফসল হয়েছে। শুধু তাই নয়, মৌমাছিরা ফুলে পরাগায়ণ ঘটিয়ে নানা ধরনের রবি শস্যেরও ফলন বৃদ্ধি করছে। এমন চিত্র দেখে এলাকার সাধারণ কৃষক আজিজুল হককে সহায়তা করেছেন। কেউ কেউ তার মতো পথও বেছে নিয়েছেন। মৌচাষে সফলতার মুখ দেখে গাজীপুরের নানা অঞ্চলের যুবকরা বাণিজ্যিকভাবে এ পেশায় আসার

আগ্রহ দেখাচ্ছেন।

বর্তমানে আজিজুল হক ৩০টির বেশি মৌবাক্স রয়েছে। প্রতি বাক্স থেকে সপ্তাহে চার-পাঁচ কেজি মধু সংগ্রহ করা যায়। সরিষা ফুল থেকে মধু সংগ্রহের উত্তম সময় অগ্রহায়ণ ও পৌষ। এ দুই মাসে অধিক পরিমাণে মধু সংগ্রহ করা যায়। তবে সরিষা ফুলের মধু অধিক ঠাণ্ডায় জমাট বেঁধে যায়। এজন্য সরিষার মধুতে থাকা গ্লুকোজকে দায়ী করা হয়। তাই তিনি লিচু, কালিজিরা ও কেওড়া ফুল থেকেও মধু সংগ্রহ করে থাকেন।

বর্তমানে এক কেজি সরিষা ফুলের মধুর দাম ৪০০-৬০০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করে। লিচু ফুলের মধু প্রতি কেজি ৬০০ টাকা। কালিজিরা মধু প্রতি কেজি ১ হাজার ২০০ টাকা। কেওড়া ফুলের মধু প্রতি কেজি ৬০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। সব খরচ বাদে এ বছর দুই-তিন লাখ টাকা আয়ের আশা করছেন তিনি।

মৌচাষের মাধ্যমে তার জীবন ও পরিবারের অভাব দূর হয়েছে। নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারছেন সামাজিক কর্মকাণ্ডেও। তিনি বর্তমানে শ্রীপুর উপজেলা মৌচাষি সমবায় সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর শ্রীপুর উপজেলা শাখার আজীবন কার্যনির্বাহী সদস্য হয়েছেন।

তিনি জানান, মৌচাষে তেমন বড় অঙ্কের টাকার প্রয়োজন হয় না, অল্প পুজিতে, স্বল্প পরিসরে এ ব্যবসা শুরু করা যায়।

শ্রীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এএসএম মইদুল হাসান জানান, শ্রীপুর অঞ্চলের মধু বিষমুক্ত ও নির্ভেজাল। এ অঞ্চলে মৌমাছিরা ফুলে পরাগায়ণ ঘটায়। ফলে রবিশস্যের ফলন দিন দিন বাড়ছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল জানান, মৌচাষ একটি লাভজনক ব্যবসা। এর সঙ্গে জড়িত সাধারণ কৃষক লাভবান হচ্ছেন।

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০