নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে সি-সেকশনের ব্যবহার (সিজারিয়ান অপারেশন) আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে। আর সরকারি হাসপাতালের তুলনায় বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় সিজারিয়ানের হার অনেক বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী, সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ বাচ্চা প্রসব সিজারিয়ানের হওয়ার পরামর্শ থাকলেও বাংলাদেশে এ হার তার কয়েক গুণ।
সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে সংস্থাটির নিজস্ব কার্যালয়ে গতকাল এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেনের সভাপতিত্বে জরিপের ফল তুলে ধরেন পপুলেশন স্টাডিজ ডিভিশনের গবেষক ড. আব্দুর রাজ্জাক সরকার।
গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান জš§ দিতে বেসরকারি হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় সিলেটে ও সবচেয়ে কম বরিশালে। সিলেটে প্রতিটি সি-সেকশন বাবদ গড়ে ব্যয় হয় ৩০ হাজার ৫৫৭ টাকা ও রাজশাহীতে ব্যয় হয় ১৫ হাজার ৭০৫ টাকা। আবার সরকারি হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় সিলেটে ১৭ হাজার ৮৩৭ টাকা। আর সবচেয়ে কম হয় রংপুরে ৭ হাজার ৩১ টাকা। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় (এনজিও) সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় হয় ২১ হাজার ৪৭৬ টাকা সিলেটে ও রংপুরে ব্যয় হয় ১২ হাজার ৮১ টাকা।
‘ম্যাসিভ বোম অব সি-সেকশন ডেলিভারি ইন বাংলাদেশ: এ হাউজহোল্ড লেভেল অ্যানালাইসিস ২০০৪-২০১৮’ শীর্ষক এ গবেষণা পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস) থেকে ২০০৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে অপারেশন করা নারীদের থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে। ২৭ হাজার ৩২৮ হাজার নারীর মধ্যে এ জরিপ চালানো হয়। তাদের বয়স ১৫ থেকে ৪৯ বছরের মধ্যে।
জরিপে জানানো হয়, দেশের ৮টি বিভাগের মধ্যে ডেলিভারিতে সরকারি হাসপাতালে ঢাকায় ১৩ হাজার ৩৮৩ টাকা, চট্টগ্রামে ১৫ হাজার ৮৩১, বরিশালে ১৬ হাজার ৮৪৬, খুলনায় ১১ হাজার ৮৯৩, রাজশাহীতে ১০ হাজার ৯৪১, সিলেটে ১৭ হাজার ৮৩৭, রংপুরে ৭ হাজার ৩১, ময়মনসিংহে ১১ হাজার ৫১৬ টাকা।
বেসরকারি হাসপাতালে সি-সেকশন অপারেশনের জন্য ঢাকায় ২৩ হাজার ১৬৮, চট্টগ্রামে ২৫ হাজার ৫০৭, বরিশালে ২৮ হাজার ৯৫৯, খুলনায় ১৫ হাজার ৭২৯, রাজশাহীতে ১৫ হাজার ৭০৫, সিলেটে ৩০ হাজার ৫৫৭, রংপুরে ১৮ হাজার ২৩০ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ১৯ হাজার ৯৭৩ টাকা ব্যয় হয়। এনজিও পরিচালিত হাসপাতালগুলোর মধ্যে ঢাকায় ২০ হাজার ৪৯৮, চট্টগ্রামে ১৫ হাজার ২৬৯, বরিশালে ১৫ হাজার ৮২৩, খুলনায় ১৪ হাজার ৭১০, রাজশাহীতে ১০ হাজার ৩৪৬, সিলেটে ২১ হাজার ৪৭৬, রংপুরে ১২ হাজার ৮১, ময়মনসিংহে ১৫ হাজার ৬১ টাকা।
একজন নারী বলেন, বর্তমানে ডাক্তাররা স্বাভাবিক ডেলিভারি করতে চান না। আমার ক্ষেত্রেই তা হয়েছে। তারা ভাবেন স্বাভাবিক ডেলিভারির চেয়ে অপারেশনে সময় কম লাগে এবং অনেকগুলো অপারেশন করা যায়। কতজন নারী সন্তান জš§ দিতে গিয়ে জীবিত থাকছে বা মারা যাচ্ছে, তাদের অপারেশনের পর সার্বিক অবস্থা বেশি একটা জানা যাচ্ছে না। অপারেশনের পর মা ও সন্তানের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়ছে, তা চিহ্নিতও করা যাচ্ছে না।
শিরিন হক বলেন, আমাদের দেশে একসময় ধাত্রী প্রথা ছিল। সেটা হারিয়ে গেছে। অথচ সন্তান জš§ নেয়ার আগের লক্ষণগুলো এসব ধাত্রী ভালোভাবে ধরতে পারেন, চিহ্নিত করতে পারেন। আবার অনেক সময় দেখা যায়, ডাক্তারকে অগ্রিম টাকা দিতে হয়। না হলে তারা আসতে চান না। কিন্তু কোনো ধাত্রীর ক্ষেত্রে এমন অবস্থা তৈরি হয়নি যে, অর্থ না দিলে মাঝরাতে তিনি আসবেন না।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. সাত্তার মণ্ডল বলেন, আগে গ্রামে ছিল মামলা। এই মামলার মাধ্যমে গ্রামের গরিব মানুষের পকেটের টাকা শহরে চলে আসত। এখন সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে সি-সেকশন অপারেশন। এই অপারেশন করাতে গিয়ে গ্রামের দরিদ্র মানুষ অর্থ জোগাড় করে শহরে ব্যয় করছেন। এ প্রক্রিয়ায় গ্রামের অর্থ শহরে চলে যাচ্ছে।
ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সরকারি ডাক্তাররাই বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করছেন, অপারেশন করছেন। ডেলিভারিতে ধনী-গরিব সবার সমান অর্থ ব্যয় হয়। কেননা প্রত্যেকেই নিজের সবকিছু বিক্রি করে হলেও সন্তানকে বাঁচাতে চান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দিকনির্দেশনা হচ্ছে, সি-সেকশন অপারেশন সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে ২০১৭-১৮ সময়ে তা ছিল ৩৩ শতাংশ। একই সময়ে ভারতে ছিল ২২ শতাংশ, পাকিস্তানে ২২ শতাংশ, নেপালে ১৬ ও মিয়ানমারে তা ১৭ শতাংশ। বছরভিত্তিক হিসাবে দেখা যায়, ২০০৩-০৪ সালে ৫ হাজার ৪১৩ জনের মধ্যে ২১৬ জন অর্থাৎ ৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ সি-সেকশন অপারেশন হয়েছিল। ২০০৭ সালে ৪ হাজার ৯০৩ জনের মধ্যে ৪২২ জন অর্থাৎ ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ, ২০১১ সালে ৭ হাজার ৩৪১ জনের মধ্যে ১ হাজার ১০৮ জন অর্থাৎ ১৫ দশমিক ০৯ শতাংশ।
২০১৪ সালে ৪ হাজার ৬২৬ জনের মধ্যে ১ হাজার ১২২ জন অর্থাৎ ২৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর ২০১৭-১৮ সালে ৫ হাজার ৪৫ জনের মধ্যে ১ হাজার ৬৭৬ জনের মধ্যে অর্থাৎ ৩৩ দশমিক ২২ শতাংশ। ড. রাজ্জাক বলেন, গ্রামে এই সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তার মূল কারণ হচ্ছে, বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো গ্রামের দিকে মোড় নিচ্ছে।