ওপর দিয়ে যেতে হয় দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায়। তিন বিঘা করিডোরের প্রথম ও শেষ গেট ভারতীয় পতাকার চিহ্ন দ্বারা তৈরি। আঙ্গরপোতা গ্রামে প্রবেশের একটি পথ এই করিডোর।
২০১১ সালের আগে করিডোরের প্রবেশপথে ধরাবাঁধা অনেক নিয়ম ছিল। এজন্য দহগ্রাম-অঙ্গরপোতা গ্রামবাসী বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতো। সেই সমস্যা এখন অতীত। সব ধরনের সমস্যা কাটিয়ে এখন ২৪ ঘণ্টাই করিডোরের গেট খোলা থাকে।
সপরিবারে আমি ২০১১ সালের পরে সেখানে একবার বেড়াতে গিয়েছিলাম। আত্মীয়-স্বজনের কাছে, বইয়ের পাতায় তিন বিঘা করিডোর ও দহগ্রাম ছিটমহলের নাম শুনেছি। সেবার স্বচক্ষে দেখি। দহগ্রাম ছিটমহলে যাওয়ার পথে ডালিয়া-তিস্তা ব্যারাজেও চোখ বুলিয়ে নিয়েছিলাম।
আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল পাটগ্রাম। প্রাইভেটকারে চড়ে সকালবেলায় রওনা দিই আমরা। তিন বিঘা করিডোরের কাছাকাছি চলে আসার সময়ে খুব উত্তেজিত ছিলাম। স্থানটির একটি চিত্র কল্পনা করে রেখেছিলাম, আর ভাবছিলাম কেমন হবে সেই তিন বিঘা করিডোর, কল্পনার সঙ্গে এর কেমন মিল দেখতে পাব এসব নিয়ে।
করিডোরে প্রবেশের মুখে ছিল বিজিবি করিডোরের চেকপোস্ট। তাদের দেখে প্রাইভেটকার থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করি। মূলত হেঁটে প্রবেশ করার উদ্দেশ্যে গাড়ি থেকে নামি আমরা। প্রবেশের আগে বিজিবির একজন সদস্য আমাদের বিভিন্ন সতর্কতামূলক কথা জানাচ্ছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, আমরা যেন মোবাইল ফোন কিংবা ক্যামেরা দিয়ে কোনো ধরনের ছবি না তুলি। তাদের দেখানো পথে আমরা ছয়জনের দল করিডোরে ঢুকি।
ভেতরে যাওয়ার পরে প্রথমে চোখে পড়ে চারমুখো রাস্তা। আর জায়গায় জায়গায় ভারতের বিএসএফের সদস্যরা দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণের জন্য মনে হয়েছিল, আমি ভারতে চলে এসেছি। ছোট ছোট রঙিন পাথর দিয়ে সাজানো রাস্তাগুলো। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিল। পথ চলতে চলতে দহগ্রামমুখী রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে আসি লাম করিডোরের অপর প্রান্তে। ইতোমধ্যে আমাদের প্রাইভেটকার করিডোরের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে হাজির হয়েছে। আমরা আবার প্রাইভেটকারে জেঁকে বসলাম দহগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদে যাওয়ার উদ্দেশে। যেতে যেতে দহগ্রামের মনোরম দৃশ্য চোখে পড়ে। একটু ভালো করে তাকালে অদূরে সীমান্তের বর্ডারগুলো দেখা যায়। এখানে জনসংখ্যা খুব কম, বসতবাড়িও খুব কম। তবে চোখে পড়ে গাছপালা আর বিস্তৃত কৃষিমাঠ।
দহগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে সেখানে পৌঁছাই আমরা। এ ভবনের সামনে বিশাল একটি মাঠ। আমরা গাড়ি থেকে নামতেই আশপাশ থেকে ছুটে আসে একদল ছোট ছেলেমেয়ে। ভিড় করে আমাদের দেখে। বুঝতে পারি, এ গ্রামে বাইরের মানুষের যাওয়া-আসা কম। তাই বাইরের অতিথিদের দেখলে তারা বেশ কৌতূহলী হয়ে ওঠে। ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলি সেদিন। তারাও খুব আন্তরিকতার সঙ্গে তাদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। ইউপি চেয়ারম্যানসহ সদস্যরা বলেন, করিডোরের গেট ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখায় অনেক সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে।
এজন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাতে ভোলেননি তারা।
গ্রামটিতে এখনও তেমন কোনো উন্নত সুযোগ-সুবিধা নেই। হাসপাতাল ও বিদ্যালয় নির্মাণের কথা থাকলেও তা সম্পূর্ণ হয়নি। তাছাড়া গ্রামটিতে দারিদ্র্যের ছাপ রয়েছে অনেকে এখনও কলাপাতায় খাবার খায়। ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা থেকে বঞ্চিত। ভালো কোনো ডাক্তার নেই, চিকিৎসার জন্য যেতে হয় পাটগ্রামে। গ্রামের জীবনযাপন নিয়ে নানা দিক তারা তুলে ধরেছিলেন। কথা বলতে বলতে আমাদের জন্য চা-নাশতারও আয়োজন করেছিলেন। এরপর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবারও সেই করিডোরে প্রবেশ করি। সুন্দর একটা জায়গা, ছবি না তুললে কি হয়! তাই বিজিবির কথা ভুলে গিয়ে হঠাৎই ছবি তোলার প্রস্তুতি নিলাম। ঠিক এ সময় খুব ভয়ংকর একটা ঘটনা ঘটে গেল। সেখানকার এক বন্দুকধারী বিএসএফ সদস্য আমাদের ওপর চড়াও হয়ে হিন্দিতে বলতে লাগলেন, তাদের হেড অফিসে ফোন দেবে, আমাদের ওপর গুলি চালাতে বাধ্য হবে। সংগত কারণে খুব ভয় পেয়েছিলাম। তাই বাক্যব্যয় না করে আমরা তাড়াতাড়ি করিডোর থেকে বেরিয়ে আসি। বাইরে এসে এ নিয়ে বেশ হাসাহাসি করি। মৃদু বাতাস বইছিল, তাই সাহস করে আরও কিছুক্ষণ কাটাই ওখানে। পরে প্রাইভেটকারে বাড়ির দিকে রওনা দিই।
কামরুন নাহার ঊষা