সবচেয়ে সস্তা ভারতের মোবাইল ডেটা
প্রশান্ত কে. রায়
ভারতের সস্তা ইন্টারনেটে আরেক ধাক্কা। এবার দাম কমিয়ে দুনিয়ার সবচেয়ে সস্তা ইন্টারনেটের খ্যাতি অর্জন করল। এ বিষয়ে বিবিসি সাম্প্রতিক সময়ে ‘পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা দরে মোবাইল ইন্টারনেট পাওয়া রাষ্ট্র’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব হলো?
বিবিসির প্রতিবেদনে যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি দর যাচাই সাইট থেকে তারা এই তথ্যাদি গ্রহণ করেছে। তারা সেখানে বলেছে, এক গিগাবাইট (জিবি) মোবাইল ডেটা খরচ ২৬ সেন্ট, যা ভারতীয় মুদ্রায় দশমিক ২০ রুপি। আর যুক্তরাষ্ট্রে এর দাম ১২ ডলার ৩৭ সেন্ট এবং যুক্তরাজ্যে ছয় ডলার ৬৬ সেন্ট। উল্লেখ্য, সারা বিশ্বে মোবাইল ডেটার গড় দাম আট ডলার ৫৩ সেন্ট।
কিন্তু অনেক ভারতীয় গ্রাহক বলছেন, তারা আসলে শূন্য দশমিক ১০ ডলারের চেয়ে কম দামে এক জিবি ব্যবহার করছেন। এমনকি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রেও একই দশা। সেখানকার গ্রাহকরাও বলছেন, বাস্তবে প্রতিবেদনে উল্লেখিত দামের চেয়ে কম মূলেই তারা মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকেন।
সত্যিকার খরচটি যা-ই হোক না কেন, এটা পরিষ্কার যে পৃথিবীর যে কোনো দেশের তুলনায় ভারতে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারে খরচ সবচেয়ে কম। কিন্তু এখানেই শেষ কথা নয়, অনেকেই বলছেন ভারতে মোবাইল ইন্টারনেটের সস্তা দশা বেশি দিন টিকবে না, এটা ক্ষণস্থায়ী। এর পেছনে কারণ হলো বড় বড় প্রতিষ্ঠান দাম কমিয়ে নতুন গ্রাহকদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে।
লন্ডনের একটি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক সৌরভ সেন বলেন, তিনি প্রতি মাসে মোবাইল ইন্টারনেটে যে অর্থ খরচ করেন, তা দিয়ে তিন-চার কাপ কফি খাওয়া যায়, যার মূল্য ১৩ ডলার। এতে থাকে আনলিমিটেড ভয়েস ও টেক্সট সুবিধা, থাকে ইইউ রোমিং ভয়েস। আর এটা প্রায় তিন জিবির কাছাকাছি। সৌরভ সেন বলেন, এর চেয়ে আরও বেশি ডেটা আমার প্রয়োজন হয় না, কেননা যুক্তরাজ্যের সব জায়গায় রয়েছে ফ্রি ওয়াই-ফাই। যুক্তরাজ্যের কিছু সস্তা ইন্টারনেট প্যাকেজও রয়েছে। তবে এশিয়ার সঙ্গে তুলনা করতে গেলে এই সর্বত্র উš§ুক্ত ওয়াই-ফাইয়ের বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। প্রতিযোগিতায় ফ্রি ওয়াই-ফাইয়ের সূচক হিসাব করলে এশিয়ার জন্য সুনাম ধরে রাখা আর সম্ভব হয় না।
সৌরভ উল্লেখ করেন, যখন তিনি ভারতে বেড়াতে আসেন, তখন তিনি মাত্র এক মেগাবাইটেই ছয় ডলার ৬২ সেন্ট পরিশোধ করে থাকেন। অর্থাৎ এক জিবিতে তখন খরচ হয় ছয় হাজার ৭৭৯ ডলার। কার্যত এখানে আমাকে যে কোনো স্থানীয় বিলের চেয়ে ৭০ হাজার গুণ বেশি পরিশোধ করতে হয়।
রাজধানী দিল্লি থেকে বেশ কিছু দূরে শহরতলি গুরগাঁওয়ে বাস করেন রামনাথ মণ্ডল। পেশায় একজন চালক। তিনি আনলিমিটেড ফ্রি কলের জন্য প্রতি মাসে তিন ডলার খরচ করেন। এই তিন ডলারের বিনিময়ে তিনি ফোরজি ডেটায় ৪২ জিবি ইন্টারনেট পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ প্রতিদিন তিনি ১.৫ জিবি ব্যবহার করেন। আবার এই একই পরিমাণ ডেটা ব্যবহার করে তিনি বিহারে অবস্থানকালে ভিডিও দেখতে পারেন এবং পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে হোয়াটস অ্যাপে কথা বলতে পারেন। অর্থাৎ প্রতি জিবিতে ছয় সেন্ট সাশ্রয়ী। অর্থাৎ সৌরভ সেন লন্ডনে বসে যা খরচ করেন, তার চেয়ে ৭০ গুণ কম খরচেই এখানে একই পরিমাণ ফোরজি ডেটা ব্যবহার করছেন।
রামনাথ মণ্ডলের সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানটির মালিক হলেন রিল্যায়েন্স জিও; একজন তরুণ টেলিকম সেবাদানকারী উদ্যোক্তা। এই বয়সেই সস্তায় ডেটা সরবরাহ করে তিনি পুরো ভারতকে মাত করে দিয়েছেন। এর সঙ্গে থাকছে তার উচ্চ গতিসম্পন্ন মোবাইল ডেটা ও ফ্রি কল সুবিধা। জিও তার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে। শুরুতেই তিনি তুমুল আগ্রাসী ফ্রি অফারগুলো দেন, যা ছিল পরীক্ষামূলক। ফলে মাত্র ছয় মাসেই তিনি প্রায় ১০০ মিলিয়ন গ্রাহক সংগ্রহ করে নিতে সক্ষম হয়। ফোরজি একমাত্র উচ্চ গতিসম্পন্ন ডেটা, যা ভয়েস ও ডেটা উভয়ের স্বার্থেই ডেটার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিভিন্ন স্পেকট্রাম ব্যবহার করে থাকে।
দুই বছরের মধ্যে জিও ভারতের তৃতীয় বৃহত্তর টেলিকম সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের হিসাব অনুযায়ী এর সঙ্গে রয়েছে ২৮০ মিলিয়ন গ্রাহক। এমনকি এই কোম্পানির নিজস্ব ফিচার ফোনও রয়েছে, যার নাম জিওফোন। এটা অবশ্য স্মার্টফোন নয়। ফোনটি ২১ ডলারের আবার ফেরতযোগ্য সিকিউরিটি জমা দিয়ে সংগ্রহ করতে হয়। শুরু থেকেই প্রতি মাসে এক ডলারের নিচে এর প্ল্যান চালু রয়েছে। এই হ্যান্ডসেটটা ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি অ্যাপস চালাতে সক্ষম, যদিও তা কোনো স্মার্টফোন নয়। অ্যাপস দুটো হলো হোয়াটস অ্যাপ ও ফেসবুক। এমনকি এটা দিয়ে ওয়াই-ফাইও চালানো যায়।
২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী ভারতে রয়েছে ৫০০ মিলিয়নের বেশি ব্রডব্যান্ড গ্রাহক। এই তথ্য দিয়েছে ভারতের টেলিকম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান টিআরএআই। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ১৮ মিলিয়ন হচ্ছে তারযুক্ত ব্রডব্যান্ড গ্রাহক। ১১৭ কোটি গ্রাহকের এই দেশে ৫৫ শতাংশ গ্রাহক বাস করে শহরাঞ্চলে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা এত বেশি হঠাৎ করেই বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো মোবাইল ফোন। আর এই পরিবর্তনের কৃতিত্ব প্রায় সিংহভাগ দিতে হয় জিও’কে।
এখন দেশটির সবচেয়ে পুরোনো টেলিকম সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো জিও’র সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তারাও এখন ফোরজি ডেটার দাম কমানো ও ফ্রিবাইজ ছুড়ে দেওয়ায় ব্যস্ত। দিল্লি শহরের আরেক চালক কালিপদ শাশমল। তিনি এয়ারটেল ছেড়ে জিও’তে যেতে চাইছেন। কিন্তু ইতোমধ্যে এয়ারটেল ছয় ডলারে প্রতি মাসে ৪০ জিবি ডেটা দেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে। এমনকি এয়ারটেলের অফারে প্রতি মাসের অব্যবহƒত ডেটা পরের মাসে যুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকছে। এর সঙ্গে থাকছে প্রতি বছরে ফ্রি আমাজন প্রাইম ভিডিও সেবা। তাই তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এয়ারটেলেই থাকার সিদ্ধান্ত পাকাপাকি করে নিয়েছেন।
এটা পরিষ্কার যে জিও ভারতে ইন্টারনেট ডেটার দাম একেবারে খাড়াভাবে নিচে নামিয়ে নিয়ে এসেছে। বাজার কি এই দরগুলো ধরে রাখতে সক্ষম হবে? বাজার বিশ্লেষণকারীরা কী বলেন? জিও গ্রাহক ধরার জন্য তাদের সেবায় সব সময়ই ভর্তুকি দিয়ে থাকে। ফলে প্রতিযোগীরা একটি প্রান্তিকতায় পড়ে যায়। জিও যখন টেলিকম ব্যবসায় নামে, তখন এখানে ১০টি টেলিকম সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ছিল। এখন ভারতে মাত্র চারটি টিকে আছে।
কিন্তু ডেটার দাম কি স্থির থাকবে? নাকি আবার চড়া হবে?
শুল্ক চাপ যখন কমে আসে তখন যে কোনো প্রতিযোগিতায় একটি মাতাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ফলে বিপুল পরিমাণ ভোক্তা বৃদ্ধি পায়। আর তখন গ্রাহকরা সাধারণভাবে যা পরিশোধ করে, তার চেয়ে অনেক কম দাম পরিশোধ করে
থাকে। ভারতের সেলুলার অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান রাজন ম্যাথাউস
এ মন্তব্য করেন।
ম্যাথাউস আরও বলেন, ‘কিন্তু এই নিচু দর টিকে থাকার মতো নয়, যদি অপারেটরগুলো নেটওয়ার্ক কাভারেজ, গুণগত মান ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ চালিয়ে যেতে থাকে। এই শিল্প খাতের মূলধনে ফিরে আসতে গেলে অপারেটরদের তাদের দর মূল্যায়ন করতেই হবে, এই পরিস্থিতি যদি তার শোধরাতে চায়।’
তবে রিলায়েন্সের চেয়ারম্যান মুকেশ আম্বানি বলেন, ‘প্রবৃদ্ধির জন্য জিও’র এখনও অনেক প্রশস্ত স্থান রয়েছে। এর মাত্র পাঁচ শতাংশ জায়গা ব্যবহার করা হচ্ছে। আমরা কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই আমাদের গ্রাহক কয়েক গুণ বাড়াতে পারি।’ তিনি কোম্পানির গত বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশে গত জুলাইয়ে বলেন, ‘এখন জিও’র রয়েছে ২১৫ মিলিয়ন গ্রাহক।’
কিন্তু ডেটার দাম এই পরিস্থিতিতে থাকবে না, তা অবশ্যই বাড়বে। কেননা ভারতের টেলিকম খাতের এই উš§ত্ত প্রতিযোগিতা বেশি দিন টিকবে না। এ রকমই দাবি করেন নিখিল পাবা নামে এক ডিজিটাল কর্মী, যার পোর্টাল মিডিয়া নামের প্রতিষ্ঠানটি ভারতের ডিজিটাল অর্থনীতির বিষয়ে পরিস্থিতি যাচাই করে।
টেলিকম অপারেটরগুলো এখন একটি প্রান্তিক জায়গায় রয়েছে। তারা তাদের আয়ের খাতে বেশ সংকুচিত হয়ে পড়েছে বলে একটি প্রতিবেদনে উঠে
এসেছে। এই দশা যে কোনো টেলিকমের মতোই জিও’কেও প্রভাবিত করবে
বা চাপে রাখবে।
‘জিও যখন শুরু করেছিল তখন বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছিল যে তারা একটি চড়া দরে স্থির থাকছে এবং প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণ করছে।’ পাবা আরও বলেন, ‘এই দর পতনের ফলে একটি ঐক্য তৈরি হয়েছে। ফলে আমরা এখন সেবা প্রদানে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছি। এই দর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এখনই মোক্ষম সময়। যেসব কোম্পানি ৩০ শতাংশ প্রান্তিকতা ব্যবহার করত, তারা আবারও সেই আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চাইছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জিও’র একটি নিকটতম সূত্র থেকে জানা যায়, জিও কখনোই তার দাম নির্ধারণে ভর্তুকি দেয় না, কিন্তু তা বাণিজ্যিকভাবে স্থানান্তরযোগ্য।
‘তাদের ভাঙন একটি নতুন প্রযুক্তি নিয়ে আসবে,’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘জিও ফ্রিকুয়েন্সির ওপর বাজি ধরতে রাজি। কেননা এখনও বিপুল পরিমাণ অব্যবহƒত ফ্রিকুয়েন্সি তাদের রয়েছে। এটা ভয়েস ও ডেটাকে একত্রিত করবে। কেউই এই স্পেকট্রাম ব্যান্ডে ভয়েস ব্যবহারে সক্ষম হবে না।’
জিও মূলত ফ্রিতে পরীক্ষামূলক সেবা দিয়েই ১০০ মিলিয়ন গ্রাহক টেনে নিতে সক্ষম হয়েছিল। এখন তাদের গ্রাহক আগের চেয়ে এবং অন্য যে কারও চেয়ে অনেক বেশি। জিও দাবি করেছে প্রতিটি গ্রাহকের কাছ থেকে তারা অতিরিক্ত ৩০ শতাংশ রাজস্ব আয় করছে, যার মূল্য দুই ডলার।
বিশেষত, চালক, শিক্ষার্থী, রাঁধুনিসহ বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা ও অর্থনৈতিক কাঠামোর মানুষেরা আজ মোবাইলে ডেটা ব্যবহার করে ভিডি দেখছে, ভিডিও শেয়ার করছে। এর পরিমাণও দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। বলা চলে, গত দুই বছরে এভাবেই ডেটা ব্যবহারের হার বেড়ে ১০ গুণ হয়েছে। প্রতিটি ব্যবহারকারী এখন প্রতি মাসে গড়ে ১০ জিবির বেশি ডেটা ব্যবহার করছে। ব্যবহারের দিক দিয়ে খসড়াভাবে এটা যুক্তরাষ্ট্রের সমান হিসাব।
কিন্তু ভারতীয়দের পাবলিক ওয়াই-ফাইয়ে ঢোকার খুব কমই সুযোগ থাকে। গুগল, রেইলটেইল করপোরেশনের রেইলওয়ার প্রকল্প একটি ফ্রি ও উচ্চগতিসম্পন্ন
ওয়াই-ফাই সেবা নিয়ে এসেছে। এটা ভারতের ৪০০টি রেলস্টেশনে দেখা যায়। এখানে খুব সামান্য প্রবেশাধিকার থাকে। এক্ষেত্রে জিও সংযোগটাই তাদের প্রধান অবলম্বন। অনেক সময় দেখা যায়, তাদের ফোনে দ্বিতীয় একটি সিম থাকে। এখানে তারা ফ্রি ভয়েস কল পায়। এভাবেই তারা পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা মোবাইল ডেটা ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে।
প্রযুক্তিবিষয়ক লেখক, দিল্লি
ভাষান্তর: মিজানুর রহমান শেলী