‘সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলতে হবে’

একটি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিভাগ-প্রধানের সাফল্যের ওপর নির্ভর করে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইওর সফলতা। সিইও সফল হলে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা বেশি হয়। খুশি হন শেয়ারহোল্ডাররা। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে সিইও’র সুনাম। প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসাব কর্মকর্তা (সিএফও), কোম্পানি সচিব, চিফ মার্কেটিং অফিসারসহ এইচআর প্রধানরা থাকেন পাদপ্রদীপের আড়ালে। টপ ম্যানেজমেন্টের বড় অংশ হলেও তারা আলোচনার বাইরে থাকতে পছন্দ করেন। অন্তর্মুখী এসব কর্মকর্তা সবসময় কেবল প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বাস্তবায়নে ব্যস্ত থাকেন। সেসব কর্মকর্তাকে নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন টপ ম্যানেজমেন্ট। শেয়ার বিজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এবার হা-মীম গ্রুপ অব কোম্পানির করপোরেট অ্যাফেয়ার্স ও মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান স্বপন কুমার গুহ মজুমদার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. হাসানুজ্জামান পিয়াস

‘সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলতে হবে’

স্বপন কুমার গুহ মজুমদার। হা-মীম গ্রুপ অব কোম্পানির করপোরেট অ্যাফেয়ার্স ও মানবসম্পদ (এইচআর) বিভাগের প্রধান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনায় বিবিএ ও মানবসম্পদের ওপর এমবিএ শেষে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। পরে সম্পন্ন করেছেন চার্টার্ড সেক্রেটারি কোর্স। তিনি বাংলাদেশ সোসাইটি অব হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টের ফেলো মেম্বার ও ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশের একজন সহযোগী সদস্য

 

শেয়ার বিজ: ক্যারিয়ার গড়ার পেছনের গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই…

স্বপন কুমার: আমার ক্যারিয়ারের শুরু ২০০৩ সালে, বেন্টলে সোয়েটার্স লিমিটেডে মানবসম্পদ (এইচআর) বিভাগে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে। এরপর স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপে কাজ করি। পরে ২০০৯ সালে বেঙ্গল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মানবসম্পদ ও করপোরেট অ্যাফেয়ার্স বিভাগে যোগদান করি। সর্বশেষ ২০১২ সালে হা-মীম গ্রুপে যোগ দেওয়ার আগে বেশ কিছুদিন চট্টগ্রামে আরকেডি গ্রুপের মানবসম্পদ বিভাগে কাজ করেছি।

 

শেয়ার বিজ: হা-মীম গ্রুপ অব কোম্পানি সম্পর্কে কিছু বলুন…

স্বপন কুমার: হা-মীম গ্রুপ বাংলাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় গ্রুপ অব কোম্পানিজ। এটি মূলত পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। এ গ্রুপে রয়েছে ২৬টি গার্মেন্ট কারখানা, ডেনিম, সোয়েটার, এমব্রয়ডারি অ্যান্ড প্রিন্টিং কারখানা, জুট মিল, পরিবহন ও চা বাগানসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। তৈরি পোশাক ও ডেনিম সরবরাহকারী হিসেবে সুপরিচিত আমাদের প্রতিষ্ঠান। গুণগত মানসম্পন্ন তৈরি পোশাক ও আধুনিক উন্নত ডেনিম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশে-বিদেশে এর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতি মাসে আমাদের প্রতিষ্ঠান প্রায় সাত মিলিয়ন পিস ওভেন গার্মেন্ট রফতানি করে। প্রায় ৫২ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে হা-মীম গ্রুপ। বর্তমানে আমাদের বিনিয়োগ খাতটি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা নতুন করে নিট প্রজেক্ট করতে যাচ্ছি। তাছাড়া আমাদের নিউজ মিডিয়া (দৈনিক সমকাল ও চ্যানেল-২৪) ইতোমধ্যে দেশ ও দেশের বাইরে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কোম্পানিটি সমাজ উন্নয়নে কাজ করে থাকে। আমরা গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেছি। আমরা কর্মীদের সবধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকি। কর্মীদের চিকিৎসাসেবাও দিয়ে থাকি। তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করছি।

 

শেয়ার বিজ: প্রতিষ্ঠানে একজন এইচআর-প্রধানের ভূমিকা কী?

স্বপন কুমার: প্রতিষ্ঠানে এইচআর-প্রধানের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও কর্মীদের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান মানবসম্পদ-প্রধানের। তাকে উভয়পক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে হয়, সবার সঙ্গে কাজ করতে হয়। এজন্য উভয়পক্ষের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য ও পছন্দনীয় ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হয়। কর্মীদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা, চাওয়া-পাওয়া ইত্যাদি ম্যানেজমেন্ট থেকে যেমন বুঝে নিতে হয়, ম্যানেজমেন্টের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানকে পৌঁছে দেওয়াও মানবসম্পদ-প্রধানের কাজ। কর্মী বাছাই, নিয়োগ, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ইনক্রিমেন্ট, পদোন্নতি, বিভিন্ন পলিসি প্রণয়ন এসব কিছুতে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপকের ভূমিকা থাকে। সঠিক কর্মী বাছাই করে তাদের উপযুক্ত স্থানে বসিয়ে দেওয়া, কর্মীদের কর্মক্ষমতা যাচাই করা, তাদের নানা সমস্যা ও তার সমাধান বের করতে হয়। অল্পকথায়, মানবসম্পদ-প্রধানকে প্রতিষ্ঠানের কৌশলগত অংশীদার বলা হয়।

 

শেয়ার বিজ: কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে আপনারা কী ধরনের পলিসি অনুসরণ করেন?

স্বপন কুমার: যে কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়, তার প্রকৃত কাজ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। সেখানে অভিজ্ঞতা, গুণাবলি, কারিগরি দক্ষতা (প্রয়োজন অনুযায়ী), কম্পিউটার দক্ষতা ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ থাকে। এরপর শর্টলিস্ট করি। আমাদের চাহিদা ও তাদের যোগ্যতার ভিত্তিতে ভাইভা বা লিখিত পরীক্ষার মধ্য দিয়ে সেখান থেকে উপযুক্ত কর্মী বেছে নিই। স্বাভাবিকভাবে নিরপেক্ষ ও সেক্টর স্পেশালিস্টদের নিয়ে তিনজনের একটি ইন্টারভিউ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা আলাদাভাবে মার্ক দিয়ে থাকেন। সবশেষে মার্ককে গড় হিসাব করে দেখা হয় কে প্রথম, কে দ্বিতীয়। এরপর আমাদের বেতন কাঠামো অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে প্রস্তাব দেওয়া হয়। সবশেষে আগ্রহীদের নিয়োগ দেওয়া হয়।

 

শেয়ার বিজ: কর্মী বাছাইয়ে অপনারা কাকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন?

স্বপন কুমার: কিছু কিছু কাজ আছে, যার প্রায়োগিক দিক রয়েছে। যেমন ধরুন, প্রোডাকশনের ক্ষেত্রে কর্মী নিয়োগে অভিজ্ঞতাসম্পন্নদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কীভাবে প্রোডাকশন হয় সে বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকতে হয়, এজন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার চেয়ে অভিজ্ঞদেরই প্রাধান্য দিয়ে থাকি। আবার ভিন্নভাবেও রিক্রুট করা হয়। যেমন অফিসার পর্যায়ে নিয়োগের সময় অনভিজ্ঞ মেধাবীদের বেছে নেওয়া হয়। তাকে কতটুকু শেখানো যাবে, তিনি কতটুকু ক্রিয়েটিভ হবেন এটি স্তরভেদে মূল্যায়ন করা হয়।

অভিজ্ঞদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, কারণ তারা অফিস সংস্কৃতিকে সহজেই ধরতে পারেন। প্রথম থেকে ভালো আউটপুট পাওয়া যায়। আর ফ্রেশদের কাজ শেখাতে সময় লাগে, কালচার বুঝে উঠতে সময় নেয়। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, ফ্রেশ কাউকে নিয়োগ দিয়ে নানা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কাজ শেখানোর পর হঠাৎ চাকরি ছেড়ে দেন। এক্ষেত্রে কাজের ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়। শিক্ষানবিসরা এ ব্যপারে আরও সচেতন হলে তাদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের জন্য ভালো হবে।

 

শেয়ার বিজ: কর্মীদের মান উন্নয়নে আপনারা বিশেষ কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন?

স্বপন কুমার: যোগদানের পর কাজের প্রকৃতি সম্পর্কে কর্মীদের বলে দেওয়া হয়। এরপর তার প্রতি নজর রাখা হয়, কর্মক্ষমতা যাচাই করা হয়। কোনো কারণে খারাপ করলে সেটি পর্যালোচনা করে সমাধান করা হয়। নানা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মান উন্নয়নের চেষ্টা চালানো হয়। একইভাবে কেউ ভালো করলে তাকে পুরস্কৃত করা হয়।

 

শেয়ার বিজ: বর্তমানে কোন কোন বিষয় মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করেন?

স্বপন কুমার: ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেকে এ পেশায় আসছেন; কিন্তু তাদের যোগাযোগ দক্ষতা তুলনামূলক কম। তারা ইংরেজিতে লিখতে পারেন কিন্তু বলতে পারেন না। এছাড়া অন্যান্য দক্ষতার কথা যদি বলি শ্রম আইন, আন্তর্জাতিক অনেক আইন বিষয়ে অনেকের ঘাটতি রয়েছে। আরেকটি ব্যাপার হলো, সন্তুষ্ট করার দক্ষতা। ম্যানেজমেন্টকে বোঝাতে হবে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে, এসব ডেটা আপনি কীভাবে রাখবেন, কীভাবে উপস্থাপন করবেন সে আর্ট আপনাকে জানতে হবে। এ বিষয়টিও অনেকের মধ্যে অনুপস্থিত। আবার শিল্পায়নের দর্শন সেই আগের জায়গায় রয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা কেন দরকার, এ বিষয়ে এখনও দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছে মালিকপক্ষ। দেশি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক সুপারিশ আমলে নিতে হয়, যা মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য অনেক চ্যালেঞ্জের।

 

শেয়ার বিজ: এ পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে কী কী গুণ থাকা জরুরি?

স্বপন কুমার: কম্পিউটার, ইংরেজি ও গণিত এ তিন বিষয়ে কেউ দক্ষ হলে শুধু এ পেশা নয়, যে কোনো পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে তারা ভালো করতে পারবেন। আর এ পেশায় সফল হওয়ার জন্য মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে চলার গুণ থাকতে হবে, মিশুক হতে হবে। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। সৎ হতে হবে। সত্য বলার সাহস থাকতে হবে। আত্মসমালোচনা করার মনোভাব থাকতে হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০