সবুজ পাহাড়ে যেন লেগেছে সোনালি রং

আলাউদ্দীন শাহরিয়ার, বান্দরবান :জুমের পাকা ধানের গন্ধ ছড়াচ্ছে বান্দরবান জেলায় পাহাড়ি জনপদে। সবুজ পাহাড়ে যেন সোনালি রং লেগেছে। চারদিকে পাহাড়ে পাহাড়ে শোভা পাচ্ছে পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠীর লাগানো জুম খেতে সোনালি রঙের পাকা ধান। কোথাও কোথাও আধাপাকা সবুজ-সোনালি জুম চাষের ধানক্ষেত। জুমক্ষেতে ধানের পাশাপাশি লাগানো সাথীফসল মিষ্টিকুমড়া, ভুট্টা, মারফা, চিনাল, মরিচ, টকপাতা ইতোমধ্যে গড়ে তোলতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন জুমিয়ারা। ফসল ভালো হওয়ায় উৎসবমুখর পরিবেশে মনের আনন্দে পরিবারের ছোটবড় সবাই মিলে ফসল সংগ্রহ করেছেন।

কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, বান্দরবান জেলার সাতটি উপজেলায় এ বছর সাত হাজার নয়শ তেত্রিশ হেক্টর জায়গায় জুমচাষ করা হয়েছে। জুম চাষে সম্ভাব্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে চাল ১২ হাজার ৫৮ মেট্রিক টন এবং ধান ১৮ হাজার ৮৭ মেট্রিক টন। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীরা প্রতি বছর বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে জুমচাষের জন্য নির্ধারিত পাহাড়ের ঝাড়জঙ্গল, গাছপালা কেটে জুম চাষের ক্ষেতের জায়গা নির্ধারণ করে। তারপর কাটা ঝাড়জঙ্গল রোদে শুকানোর পর মার্চ-এপ্রিলে মাসে পাহাড়ের আগুন লাগিয়ে কাটা ঝাড়জঙ্গল আগুনে পুড়িয়ে ফেলে জমি প্রস্তুত করে। পরে এপ্রিল মাসজুড়েই জুমের জায়গা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ধানের বীজ বপনের জন্য কাক্সিক্ষত বৃষ্টির অপেক্ষা করেন। প্রথম বৃষ্টির পরই জুমক্ষেতের জায়গায় জুমের ধানসহ সাথী ফসলের বীজ রোপণ করে। যারা বৈশাখ মাসের প্রথম বৃষ্টির পর পরই জুমক্ষেতে বীজ লাগাতে পারেন, তাদের ক্ষেতের ধান আগাম পাকতে শুরু করে। প্রতি বছর আগস্ট মাসের শেষে অথবা সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে জুমের ধান কাটা শুরু হয়। এদিকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস পর্যন্ত জুমক্ষেতের ধানসহ ফসল গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চলে। জুমক্ষেতে ধান ছাড়াও মিশ্র সাথী ফসল হিসেবে তুলা, ঠান্ডা আলু, যব, মিষ্টিকুমড়া, ভুট্টা, মারফা ফল, চিনাল ফল, আমিলাগুলো বীজ, মরিচ, তিল, বেগুন, সাবারাং, ধনিয়া পাতার বীজ, কাকন বীজ জুমের জায়গায় ছিটিয়ে দেয়া হয়। এদিকে জুমের ধান কাটা, মাড়াই করা এবং রোদ্রে শুকানোর পর পাহাড়ের জুমঘর থেকে পাহাড়ি পল্লিগুলোতে গ্রামের ঘরে ধান স্থানান্তর করার পর জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত পাহাড়ি পল্লিগুলোতে চলে নবান্ন উৎসব।

ম্রো জনগোষ্ঠীর লেখক ও গবেষক সিইয়ং ম্রো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ১১টি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। জনগোষ্ঠীগুলোর জীবনধারণ কৃষ্টিকালচারও ভিন্ন ভিন্ন। এমনকি তাদের চাষাবাদ পদ্ধতিও ভিন্ন। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীরা পাহাড়ের ঢালুতে আদি পদ্ধতি অনুসরণ করে জুম চাষ করে। জুম চাষের মাধ্যমেই প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাহাড়িরা এখনও জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। এ চাষে কোনো সেচ দেয়া লাগে না, প্রাকৃতিকভাবে রোদ-বৃষ্টিতে ফসল ফলে। নির্দিষ্ট একটা সময়ে পাহাড়ের বন-জঙ্গল কেটে রোদে শুকিয়ে, আগুনে পোড়ানো উচুনিচু ঢালু পাহাড়ের জমিতে ধানসহ প্রায় ত্রিশ প্রজাতির ফসলের চাষ করে। আদিপদ্ধতি পাহাড়ে জুমক্ষেতে চাষাবাদ এবং ফসল উৎপাদনের এ পদ্ধতিকে জুমচাষ বলা হয়। তবে জুম চাষের পরিমাণ আগের চেয়ে আস্তে আস্তে কমছে। কারণ প্রতি বছর একি জায়গায় জুম চাষ করা যায় না। কমপক্ষে তিন চার বছর পর পর একেকটা পাহাড়ে জুম চাষ করতে হয়।

থানচির দিনতে ম্রোপাড়ার বাসিন্দা জুমচাষি দৈলাং ম্রো ও রেয়াংরি ম্রো বলেন, জুমক্ষেতের ফসল গড়ে তোলার কাজে ব্যস্ত তারা। পরিবারের ছোটবড় সবাই নেমেছেন জুমক্ষেতের ফসল সংগ্রহে। এ বছর চারশ শতকের মতো জায়গায় পাহাড়ে জুম চাষ করতে পেরেছেন তারা। এবার জুমের ধান তেমন ভালো হয়নি, কারণ যখন বৃষ্টির দরকার ছিল তখন বৃষ্টি হয়নি, আর যখন রোদ্র দরকার ছিল, তখন অতিবৃষ্টি হয়েছে। তারপরও ৪শ আড়ি ধান পাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তারা। কিন্তু  ফলন ভালো হলে ৬শ আড়ি ধান পেত।  তবে ধান কম হলেও সাথী ফসল মিষ্টিকুমড়া, ভুট্টা, মারফা, চিনাল, মরিচ, টকপাতা দিয়ে ক্ষতি অনেকটা পুষিয়ে যাবে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এম এম শাহনেয়াজ বলেন, এ বছরের শুরুতে বৃষ্টিপাত কম এবং শেষের দিকে অতি বৃষ্টির কারণে জুম চাষের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। জেলায় জুমচাষিদের ক্ষতির পরিমাণ দেড় কোটি টাকার মতো। তবে যেসব জুমক্ষেতের ধান এখনও পাকেনি সেগুলোর ভালো ফলন হবে। জুমচাষিদের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করায় ফসলের উৎপাদন আগের চেয়ে বেড়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০