নিজস্ব প্রতিবেদক: করপোরেট ট্যাক্সে সমতা আনা, পে-রোল ট্যাক্সে মনিটরিং বাড়ানো ও ভ্যাটে অটোমেশনের সুপারিশ করেছে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই)। অপরদিকে করের আওতা বাড়াতে সব ক্ষেত্রে উৎসে কর আদায়ের পরামর্শ দিয়েছে প্রাইসওয়াটার হাউজ কুপার প্রাইভেট লিমিটেড (পিডব্লিউসি)।
গতকাল সেগুনবাগিচায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সম্মেলন কক্ষে এনবিআরের সঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও পেশাজীবীদের প্রাক-বাজেট আলোচনায় এসব প্রস্তাব দেওয়া হয়। সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া সভাপতিত্ব করেন।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর করপোরেট কর বিষয়ে বলেন, করপোরেট করের ক্ষেত্রে আমাদের খাতভিত্তিক কিছু বৈষম্য রয়েছে। টেলিকম খাতে উচ্চহারে করারোপ করা হয়েছে, যা সরাসরি বিনিয়োগকে আঘাত করে। দেশে ফোরজি আসছে, ফাইভজি আসবে। উচ্চ করের কারণে তা বাধাগ্রস্ত হবে। টেলিকম খাত বর্তমানে ৪৫ শতাংশ করপোরেট কর দেয়। এ হার কমানো উচিত। সর্বোচ্চ করহার ৩০ শতাংশ। আবার সারচার্জ বসানো হচ্ছে। সম্পদ থাকলে, ফ্ল্যাট কিনলে সারচার্জ হবে, বাড়ি থাকলে সারচার্জ হবে না এটা তো সমতা হতে পারে না। সারচার্জ সম্পদের মূল্য অনুযায়ী হওয়া উচিত।
ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো ঠিক হবে না বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অন্যান্য দেশে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ালে কিন্তু কর আহরণ বাড়ে না। আমেরিকায় করমুক্ত আয়সীমা জাতীয় আয়ের সঙ্গে ব্যবধান এক থেকে ১০ শতাংশ। আমাদের দেশে দুই থেকে ২০ শতাংশ। করমুক্ত আয়সীমা আমাদের বাড়ালে কর বাড়বে না। পে-রোল ট্যাক্স আদায়ে আরও বেশি প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। অটোমেশন সিস্টেম থাকা উচিত যাতে মনিটরিং করা যায়। পে-রোল ট্যাক্স নিয়ে এখন কোনো মনিটরিং নেই। ১০ শতাংশ দিচ্ছে, কিন্তু ৩০ শতাংশ তো দিচ্ছে না। মনিটরিং করলে এ খাত থেকে অনেক আয় হবে। উন্নত দেশে ব্যক্তি কর থেকে ৮০ শতাংশ আসে, আমাদের আসে মাত্র তিন শতাংশ। ইংল্যান্ডে এ হার ৮৫ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ায় ৬২ শতাংশ।
ভ্যাট বিষয়ে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে ভ্যাট খাতে অটোমেশন বেশ ভালো এগিয়েছে। দুই বছরের জন্য নতুন আইন পিছিয়ে যাওয়ায় অটোমেশনও পিছিয়ে গেছে। কিন্তু বাজেটে সিদ্ধান্ত হয় ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইনকে সামনে রেখে কিছু আইন পরিবর্তন করে অটোমেশন করে ফেলা হবে। ভালো উদ্যোগ, কারণ অটোমেশনের সঙ্গে আইনের কোনো সম্পর্ক নেই। জাতীয় স্বার্থে এটা করা উচিত। বড় ব্যবসায়ীরা অটোমেশনের পক্ষে।
টোব্যাকো ট্যাক্স নিয়ে তিনি বলেন, গত বছর বাজেটে নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু উচ্চস্তরে সিগারেটের দাম বাড়ানো হয়নি। উচ্চ ও নিম্নস্তরের সিগারেটের রাজস্বের পার্থক্য পাঁচ-সাতগুণ। গতবছর নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিড়িতে কিছু কর বাড়াতে এ বছর এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা পাবে। গতবছর পেয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। এ বছর সিগারেট নয়, বিড়ির ওপর কর বেশি বাড়াতে হবে, যাতে বিড়ির ভোক্তা সিগারেটে যায়। তামাকের ব্যবহার কমাতে হলে বিড়ির ওপর কর বাড়াতেই হবে। তাহলে ব্যবহার কমবে।
সভায় প্রাইসওয়াটার হাউজ কুপার প্রাইভেট লিমিটেডের (পিডব্লিউসি) ম্যানেজিং পার্টনার মামুন রশীদ করের পরিধি বাড়াতে সব ক্ষেত্রে উৎসে কর আদায়ের পরামর্শ দিয়ে বলেন, উৎসে কর প্রদান করলে প্রতিষ্ঠানগুলো রেয়াত নেওয়ার জন্য ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেবে। এখন অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা ই-টিআইএন ছাড়াই ব্যবসা করছে। ব্যবসা শুরুর আগেই তাদের কাছ থেকে কর কেটে রাখলে পরে সমন্বয় করার স্বার্থে তারা করের আওতায় আসবে। তিনি ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে অর্থপাচার রোধেও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দেন।
পিডব্লিউসির ট্যাক্স লিডার সুম্মিতা বসু বলেন, ‘অন্যান্য উৎস থেকে আয়’ খাতে লভ্যাংশের ওপর ২০ শতাংশ কর দিতে হয়। বাংলাদেশের আইন ও ব্যবসায় নিয়ম অনুযায়ী বিশেষ উদ্দেশ্যে বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান গড়ার বিধান রয়েছে। তবে মূল কোম্পানির লভ্যাংশের কর দেওয়ার পর সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের মুনাফার আয়ে বহুস্তরমুখী কর প্রচলন থাকায় এক মুনাফায় কয়েক দফা কর দিতে হয়। এতে শেয়ারগ্রাহকদের সক্ষমতা বাড়ে না।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, করপোরেট ট্যাক্স নিয়ে আমরা চিন্তা করছি। তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য করপোরেট করহার আরও আকর্ষণীয় করার চিন্তা-ভাবনা করব। ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা না বাড়িয়ে নি¤œ পর্যায়ে কিছু সুবিধা দেওয়া যায়। করহার ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে আনার চিন্তা করছি। ভ্যাট অটোমেশনে আমরা কাজ করছি। টোব্যাকো করের ক্ষেত্রে এবার আমরা নতুন কিছু করার চেষ্টা করব, যার ফলে নি¤œস্তরের সিগারেট সহজলভ্য না হয়। বিডির সঙ্গে সিগারেটের পার্থক্য বেশি রাখা ঠিক হবে না। রফতানি বাড়াতে পোশাক খাত ছাড়া অন্য কোন খাতে ইনসেনটিভ দেওয়া যায়, সে বিষয়ে সরকার ভাবছে।
তিনি বলেন, উৎসে কর যাদের থেকে নেওয়া হয় পরে তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। সেজন্য তাদের করের আওতায় আনা যায় না। সেজন্য করমুক্ত আয়সীমায় আয় না বাড়িয়ে করহার কমালে তারা করের আওতায় আসবে। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরও সুবিধা বাড়ানোর চিন্তা করা হবে। আমরা ট্রান্সফার প্রাইন্সিং নিয়ে কাজ করতে পারছি না। এর মাধ্যমে কখনও কখনও মানিলন্ডারিং হয়। আগামী এক বছরের মধ্যে অনলাইন সিস্টেম ইসিআর স্থাপন করা হবে।
সব ক্ষেত্রে উৎসে কর চায় পিডব্লিউসি
