শেখ আবু তালেব: ঋণ বিতরণে ব্যাংকের মূল শক্তি হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়ী আমানত। মোট আমানতের প্রায় অর্ধেকই আসে এ খাত থেকে। করোনা মহামারিতে এবার দীর্ঘমেয়াদি এসব সঞ্চয়ী আমানতের পরিমাণ কমেছে ১৪ হাজার কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকের গ্রাহকসংখ্যা কমেছে পৌনে দুই লাখ। দেশের ব্যাংকগুলোর আমানত চিত্রের ওপর তৈরি করা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে এমন তথ্য।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষের আয় কমে যাওয়ায় সঞ্চয় ভেঙে জীবন চালাচ্ছেন। মেয়াদ শেষ হওয়া ১৪ হাজার কোটি টাকা আবার দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় হিসাবে যায়নি। এভাবে সঞ্চয়ী আমানত কমে গেলে ব্যাংকের ঋণ বিতরণে সমস্যা তৈরি হবে। ঋণ-আমানত অনুপাত (এডি রেশিও) বেড়ে যাবে। মঞ্জুর হওয়া ঋণ বিতরণ করতে গিয়ে আমানত সংকটে পড়বে অনেক ব্যাংকই। তখন কলমানির পাশাপাশি আমানত সংগ্রহে সুদের হার বাড়িয়ে দেবে ব্যাংকগুলো।
জানা গেছে, গত এপ্রিল-জুন সময়ে দেশের ব্যাংকগুলোয় মেয়াদি আমানতের হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪২ লাখ ৯১ হাজার ৪৪৩টি। এর আগের প্রান্তিকে (জানু-মার্চ, ২০২০) যা ছিল ৪৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৭টি। তিন মাসের ব্যবধানে হিসাবের সংখ্যা কমেছে এক লাখ ৭৩ হাজার ১৩৪টি।
গত এপ্রিল-জুন প্রান্তিক শেষে দেশের ব্যাংকগুলোয় মেয়াদি আমানত বা ফিক্সড ডিপোজিটের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৬৫ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ৪৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ। তিন মাস আগে মেয়াদি আমানতের পরিমাণ ছিল পাঁচ লাখ ৭৯ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের মোট আমানতের ৪৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ ছিল।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জ্জা এবি আজিজুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘করোনা মহামারিতে মধ্যবিত্তদের আয় কমেছে সবচেয়ে বেশি। জীবননির্বাহে বাধ্য হয়ে তারা ব্যাংকে থাকা মেয়াদি আমানত বা ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙতে শুরু করেছেন। এটি দীর্ঘ মেয়াদে অব্যাহত থাকলে ব্যাংকের জন্য ঋণ বিতরণে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। আমানত প্রবাহ কমে যেতে পারে ব্যাংক খাতে।’
মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে মেয়াদি আমানতের পরিমাণ কমেছে ১৩ হাজার ৯৪৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা। শুধু মেয়াদি আমানতের পরিমাণই কমেনি, একইসঙ্গে কমেছে মোট আমানতের বিপরীতে শতাংশের হারও। তিন মাসের ব্যবধানে এ হার কমেছে তিন দশমিক ১৪ শতাংশীয় পয়েন্ট।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলো মূলত বিভিন্ন ধরনের আমানত সংগ্রহ করে থাকেÑসাধারণ সঞ্চয়ী, কারেন্ট হিসাব, ব্যবসায়ী হিসাব, বৈদেশিক মুদ্রা হিসাব ও বিশেষ নির্দেশনার হিসাব। এর মধ্যে অনেক হিসাবে থাকা আমানতের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে কোনো প্রকার সুদ বা মুনাফা দিতে হয় না গ্রাহককে। উল্টো কিছু হিসাব থেকে প্রতিবছর সেবা ফি কেটে রাখা হয়। এসব হিসাবে রাখা আমানতের অর্থ গ্রাহককে চাহিবামাত্রই দিতে হয় ব্যাংকগুলোকে।
কিন্তু মেয়াদি সঞ্চয়ী হিসাবে থাকা আমানত একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রাখতে পারে ব্যাংক। ছয় মাস ও এক থেকে দুই, তিন, ১০ বা তদূর্ধ্ব বছরের জন্য সাধারণ নির্দিষ্ট পরিমাণের সঞ্চয় রাখেন গ্রাহকরা। এছাড়া মাসিক কিস্তি হিসাবেও এসব ব্যাংক হিসাবে অর্থ রাখেন গ্রাহকরা।
এসব অর্থই ব্যাংকের ঋণ বিতরণের মূল চালিকাশক্তি। এই আমানতের ওপর নির্ভর করেই ব্যাংকগুলো ঋণ মঞ্জুরের পরিকল্পনা নিয়ে থাকে। যে ব্যাংকের মেয়াদি আমানতের পরিমাণ যত বেশি, ওই ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্যকে তত শক্তিশালী।
মেয়াদি আমানতের পরিমাণ কমে এলে ব্যাংকের ঋণ প্রদান সক্ষমতা কমে যায়। তখন দৈনন্দিন প্রয়োজন ও মেয়াদোত্তীর্ণ আমানতের অর্থ ফেরত দিতে ব্যাংকগুলোকে ধার করতে হয়। কলমানি মার্কেট থেকে তখন ব্যাংকগুলোর ধার বৃদ্ধি পায়। এতে সুদ ব্যয় বৃদ্ধি পায় ব্যাংকগুলোর। চাহিদা মেটাতে ব্যাংকগুলো তখন বাধ্য হয়ে বাজার রেটের চেয়ে উচ্চ সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করার ঘোষণা দেয়। ব্যাংক কর্মীদের আমানত সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অস্বাভাবাবিকভাবে চাপিয়ে দেয়।
জানা গেছে, দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়ী আমানতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ হচ্ছে ছয় মাসের কম সময়ের আমানত। গত জুন শেষে এ হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৫৭ হাজার ২৫৭টি, গত মার্চ শেষে যা ছিল ১৭ লাখ ৫৩৬ হাজার ৫৪টি। তিন মাসের ব্যবধানে এ হিসাবসংখ্যা কমেছে ৯৬ হাজার ৩৯৭টি। সবেচেয়ে বেশি পাঁচ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়ী হিসাব কমেছে তিন বছরের অধিক সময়ের মেয়াদির বেলায়।
ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণ বিতরণের সর্বোচ্চ সুদ হার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত এপ্রিল থেকে এটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সব ব্যাংকই আমানতের সুদহার কমিয়েছে। সর্বোচ্চ সাড়ে চার থেকে ছয় শতাংশে আমানত সংগ্রহ করার ঘোষণা দিয়েছে ব্যাংকগুলো। অথচ আমাদের বার্ষিক মূল্যস্ফীতিই হচ্ছে সাড়ে পাঁচ শতাংশের মতো। ফলে ব্যাংকে টাকা রাখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছেন গ্রাহকরা।
অপরদিকে করোনা মহামারিতে মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমে গেছে। এতে সবচেয়ে বেশি আয় কমেছে স্বল্প ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির। তাই সঞ্চয় ভাঙতে শুরু করেছেন তারা। দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়ী হিসাব থেকে অর্থ তুলে নিচ্ছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এমনিতেই দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে ১৫টির মতোর তারল্য সংকট রয়েছে। করোনাকালে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ তারল্য সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু সঞ্চয়ী আমানত কমে গেলে করোনা মহামারি শেষে এসব ব্যাংকের তারল্য সংকট আরও তীব্র হবে। অনেক ক্ষেত্রে কয়েকটি ব্যাংকের টিকে থাকাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে।