সব নাগরিকের জন্য চাই নিরাপদ খাদ্য

ইমদাদ ইসলাম: খাদ্য মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা ও সাংবিধানিক অধিকার। মাতৃগর্ভ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য অপরিহার্য। বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য জরুরি হলেও তার চেয়ে বেশি জরুরি নিরাপদ খাদ্য। সুস্থ-সবল, মেধাবী ও কর্মঠ জাতি গড়ে তুলতে নিরাপদ খাদ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। নিরাপদ খাবারের ওপরই নির্ভর করে আগামী প্রজšে§র শরীর, মন ও বুদ্ধির যথাযথ বিকাশ। নিরাপদ খাদ্য যেমন সবার জন্য প্রয়োজন, তেমনি নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে প্রয়োজন পণ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ, সরবরাহ ও বিপণন প্রতিটি পর্যায়ে সচেতনতা। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ দেশের আপামর জনসাধারণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে প্রো-অ্যাক্টিভ ও রি-অ্যাক্টিভমূলক বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়মিতভাবে পরিচালনা করে চলেছে। সরকার বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন হতে ভোগ পর্যন্ত সব স্তরের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ, পরিবীক্ষণ এবং নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার কার্যাবলির সমন্বয় সাধনের কাজ করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের যাবতীয় কার্যক্রমের মধ্যে জনসাধারণের মাঝে খাদ্য উৎপাদন হতে ভোক্তা পর্যন্ত প্রত্যেকটি পর্যায়ে নিরাপদ খাদ্যবিষয়ক সচেতনতা তৈরি করা, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নিরাপদ খাদ্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্কুল সেমিনার, বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্যের নমুনা সংগ্রহ এবং তা সরকার কর্তৃক স্বীকৃত ল্যাবে পরীক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা, নমুনা বিশ্লেষণ করা, ঝুঁকি নিরূপণ ও ঝুঁকি বিশ্লেষণ করা, খাদ্য স্থাপনা মনিটরিং করা, খাদ্য স্থাপনায় নিরাপদ খাদ্য সংশ্লিষ্ট অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হলে নিয়মিত পরামর্শ প্রদানের পাশাপাশি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা, অন্যান্য সরকারি সংস্থাকে খাদ্যের মান ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, বিপণন, বাজারজাতকরণ ইত্যাদি বিষয়ে সহযোগিতা প্রদান করা অন্যতম।প্রত্যাশিত ব্যবহার ও উপযোগিতা অনুযায়ী মানুষের জন্য বিশুদ্ধ ও স্বাস্থ্যসম্মত আহার্যই নিরাপদ খাদ্য। অনিরাপদ খাদ্য শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণই নয় বরং দেহে বিভিন্ন রোগের বাসা বাঁধারও কারণ। নিরাপদ খাদ্য মানুষের অন্যতম প্রধান মৌলিক অধিকার। তাই আমাদের খাদ্য নিরাপদ, পুষ্টিকর ও সুষম হওয়া প্রয়োজন। নিরাপদ খাদ্য একদিকে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে অন্যদিকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথ সুগম করে। দীর্ঘজীবন ও সুস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার অত্যাবশ্যক।


জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের গুরুত্ব অপরিসীম। সবার জন্য পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি)-এর লক্ষ্যমাত্রা ২, ৩, ৬, ৮, ১২, এবং ১৭ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চয়তার সঙ্গে সম্পর্কিত। সরকার এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তিতে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। সমগ্র খাদ্যশৃঙ্খলের শুরু হতে ভোক্তা পর্যন্ত দূষণ ও ভেজালমুক্ত নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ প্রণীত হয়। এই আইন বাস্তবায়নে খাদ্যের পুষ্টিমান ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে সরকারের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী সংস্থা হিসেবে ২০১৫ সালের ০২ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।

টেকসই উন্নত বাংলাদেশ এবং সুখী সমৃদ্ধ জাতি গঠনে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্য অত্যাবশ্যক। খাদ্যের নিরাপদতা রক্ষার মাধ্যমে অপচয় ও ক্ষতি হ্রাস এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ সম্ভব হবে। এর দ্বারা প্রতিটি নাগরিকের সুস্বাস্থ্য ও পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটবে। ভবিষ্যতে উন্নত এবং বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে গবেষণা ও বিদ্যমান পরীক্ষাগারগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশাধিকার, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষ কাজ করছে।

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক দেশের কৃষি ও খাদ্যপণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে অনলাইনে স্বাস্থ্য সনদ/ই-হেলথ সার্টিফিকে সিস্টেম চালু করেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছয়টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ১৪টি খাদ্যপণ্যের ই-হেলথ সার্টিফিকেট ইস্যু কর হয়েছে। খাদ্যদ্রব্য পরীক্ষাগারগুলোর ডাইরেক্টরি তৈরি এবং তা সফটওয়্যার ব্যবস্থাপনায় হালনাগাদ তথ্য অংশীজনের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। হারমোনাইজেশনের নিমিত্তে ২৭টি ঞবপযহরপধষ ডড়ৎশরহম ৎেড়ঁঢ় গঠন করে কর্তৃপক্ষের বর্তমান প্রবিধি হালনাগাদপূর্বক নতুন প্রবিধি খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ছয়টি খসড়া প্রবিধান ডঞঙ-তে নোটিফাই করা হয়েছে। বাকি খসড়াগুলো একই প্রক্রিয়া ডঞঙ-তে নোটিফাই এবং গেজেট নোটিফেকেশনের পরবর্তী কার্যক্রম চলমান আছে।

নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করার নিমিত্তে সাতটি সচেতনতামূলক গণবিজ্ঞপ্তি কয়েক ধাপে ৫২টি বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিক পত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত টিভিসিগুলো দেশের জনবহুল টিভি চ্যানেল প্রচার করা হয়েছে। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বহুল প্রচারিত ও জনপ্রিয় তিনটি রেডিওতে নিরাপদ খাদ্যবিষয়ক বার্তা প্রচার করা হয়েছে। জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবসে ও পবিত্র মাহে রমজান উপলক্ষে বিটিআরসির সহযোগিতায় সব মোবাইল অপারেটরের মাধ্যমে ছয়টি ক্ষুদে বার্তা প্রেরণ করা হয়েছে। ৪৯৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেমিনার/কর্মসূচি আয়োজন করা হয়েছে এবং এতে কম-বেশি অর্ধলাখ শিক্ষার্থীকে নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে অবহিত হয়েছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরে ২২০টি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ৬ হাজার ৯৮০ অংশীজন/খাদ্যব্যবসায়ীকে নিরাপদ খাদ্যবিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে এবং হচ্ছে। গৃহিণীদের নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে সচেতন করার নিমিত্তে প্রতি ব্যাচে ২৫ জন করে ১৯২টি উঠান বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। এতে মোট ৪ হাজার ৮০০ জন অংশগ্রহণ করেন। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ হাজার ৭০টি খাদ্য নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। নমুনা পরীক্ষান্তে ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায় ৯৭৯টি নমুনায় পরীক্ষিত প্যারামিটার অনুমোদিত মাত্রার মধ্যে এবং ৯১টি নমুনা অনুমোদিত মাত্রা বহির্ভূত। মাত্রা বহির্ভূত প্রাপ্ত নমুনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, পণ্য প্রত্যাহার, জনসাধারণের জন্য গণবিজ্ঞপ্তি জারিসহ বিবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।

নিরাপদ খাবার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ঢাকাসহ সারাদেশে মনিটরিং এবং এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম (মোবাইল কোর্ট) জোরদারকরণ করা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১১ হাজারেরও বেশি খাদ্য স্থাপনা মনিটরিং করা হয়েছে এবং কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ১৫৫টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। ফুটপাতে নিরাপদ পথ খাবার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ঢাকার আটটি স্ট্রিট ফুড জোন পরিদর্শন করা হয়েছে। পরিদর্শনকৃত স্ট্রিটফুড জোনগুলো হলো: মতিঝিল ব্যাংকপাড়া এলাকা, ঢাকা মেডিকেল কলেজসংলগ্ন এলাকা, রবীন্দ্র সরোবর, ধানমন্ডি, লালমাটিয়া, বেইলী রোড, পান্থপথ ও আগারগাঁও। সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রায় তিন শতাধিক পথ খাদ্যস্থাপনা পরিদর্শন করা হয়েছে।

পথ খাবারকে নিরাপদ করার লক্ষ্যে রাজধানীর আগারগাঁও ও বেইলী রোড এলাকায় দুটি নিরাপদ স্ট্রিটফুড জোন প্রস্তুতের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে আগারগাঁও ও বেইলী রোড এলাকাস্থ ১৫০ জন খাদ্যকর্মীকে দুই দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। সব খাদ্যকর্মীর মধ্যে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সহায়তায় সেইফটি ম্যাটারিয়ালস বিতরণ করা হয়েছে। নিরাপদ ইফতার নিশ্চিতের লক্ষ্যে গত রমজান মাসে কম-বেশি ২০০ ইফতার প্রস্তুতকারীদের নিয়ে সচেতনতামূলক কর্মশালা আয়োজন করা হয়। এছাড়াও বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সঙ্গে গড়ট স্বাক্ষরিত হয়েছে। ওই গড়ট এর আলোকে ঢাকাসহ অন্যান্য পর্যটন এলাকার ঝঃৎববঃ ঋড়ড়ফ ঠবহফড়ৎ-দের সমন্বিতভাবে প্রশিক্ষণ প্রদানের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড এবং সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে এ কার্যক্রমসমূহ গ্রহণ করা হচ্ছে। এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে বাকি জোনগুলোতে একই ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।

সব নাগরিকের খাদ্যের মৌলিক চাহিদাপূরণ রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। যথাযথভাবে এ সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, সুখী-সমৃদ্ধ সমাজ গড়তে এবং একটি টেকসই উন্নত ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে বর্তমান সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০