সেলিনা আক্তার: প্রত্যেক মানবশিশুর মধ্যেই সুপ্ত প্রতিভা লুকিয়ে থাকে। সুযোগ ও অনুকূল পরিবেশ পেলে সব শিশুই তাদের সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করতে পারে। শিশুদের যেরকম পরিবেশে রাখা হবে, তারা ঠিক সেরকমভাবেই গড়ে উঠবে। শিশুরাই টেকসই উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। শুধু ব্যক্তিস্বার্থে নয়, দেশের স্বার্থে সব শিশুর জন্য শিশুবান্ধব পরিবেশ আবশ্যক। সব শিশুর সমান অধিকার নিশ্চিত করা এ সঙ্গে আবশ্যক। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছেÑ ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠাÑযেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করা হইবে।’ ভবিষ্যতের আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সব শিশুর অধিকার ও নিরাপত্তার বিষয়ে আমাদের সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। একইভাবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই তারা দেশের আলোকিত নাগরিক হয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ হবে। তাছাড়া, শিশুদের বড় অংশ যদি পুষ্টিহীন, অশিক্ষিত বা স্বাস্থ্যহীন থাকে, তাহলে কোনো রাষ্ট্র উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে না। কেননা, উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সুস্থ-সবল ও শিক্ষিত মানবসম্পদ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ সত্য উপলব্ধি করতে পেরেই সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে সর্বক্ষেত্রে সব শিশুর সার্বিক বিকাশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয় ঐতিহাসিক শিশু অধিকার সনদ। ৫৪টি অনুচ্ছেদের সমন্বয়ে গঠিত শিশু অধিকার সনদে রাষ্ট্রের দায়িত্বসহ পিতা-মাতা ও অভিভাবকদের করণীয়, পালনীয় বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। ১৯৯০ সালে এ সনদ আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়। কিন্তু, বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শিশু অধিকার বিষয়ক কার্যক্রমের সূচনা করেন জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ গৃহীত হওয়ার অনেক আগে। তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে দুস্থ, এতিম, আশ্রয়হীন, সুবিধাবঞ্চিত শিশুসহ সব শিশুর কল্যাণ ও অধিকার সংরক্ষণের জন্য ১৯৭৪ সালে শিশু আইন প্রণীত হয়। সব শিশুর সমান অধিকার রক্ষায় বঙ্গবন্ধুর অবদানের জন্যই বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ১৭ মার্চকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে উদযাপন করা হচ্ছে। এ বছর ২০২২ সালে জাতীয় শিশু দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের অঙ্গীকার, সকল শিশুর সমান অধিকার’। সরকার সব শিশুর সমান অধিকার নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। এজন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে সব শিশুর অধিকার রক্ষায় কাজ করছে। কারণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে সোনার বাংলা গড়ার অন্যতম শক্তি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজš§, যারা আজকের শিশু।
জাতির পিতার মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শিশুদের খুব ভালোবাসেন। শিশু কল্যাণ ও সব শিশুর সমান অধিকার নিশ্চিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে শিশুবান্ধব পরিবেশ গড়ে উঠেছে। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৩-২০২৫ প্রণয়ন করা হয়েছে। আগামী দিনের জাতি গঠনে পূর্ণমাত্রায় শিশুর মেধা বিকাশ নিশ্চিত করা এবং শিশুর কল্যাণ, সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে শিশু আইন ২০১৩। এছাড়া শিশু অধিকার বিষয়ে শিশুশ্রম নিরসন আইন, জাতীয় শিশুনীতি ২০১১, শিক্ষানীতি ২০১০, স্বাস্থ্যনীতি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ প্রভৃতি আইন ও নীতিমালা তৈরি করেছেন। তিনি শিশুদের জন্য বিনামূল্যে বই প্রদান, উপবৃত্তি, মিড-ডে-মিল, সব প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণসহ প্রভৃতি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। শিশুদের সার্বিক উন্নয়ন ও শিশুবান্ধব বিভিন্ন নীতি ও আইন প্রণয়নে বাংলাদেশ সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। এজন্য শিশু বিষয়ক বিভিন্ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে রয়েছে।
তাছাড়া, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অন্যতম প্রধান কাজ হলো শিশু অধিকার বাস্তবায়ন এবং শিশুর সুরক্ষা ও উন্নয়নে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা। কারণ, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অধিকারকে পাশ কাটিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব নয়।
সঠিক পরিচর্যা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিশুর প্রতিভা বিকশিত করতে হবে। শিশুর মেধা মনন বিকাশের মাধ্যমে তদের আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। প্রাপ্তবয়স্কদের মতো শিশুদেরও যে সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকার রয়েছে, তা অনেকেই মেনে নিতে চায় না। সামাজিক এ ধারণা শিশু অধিকার নিশ্চিতে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউনিসেফের প্রতিবেদন বলছেÑবাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশেরও বেশি শিশু রয়েছে। সংখ্যার হিসেবে প্রায় ১৭ লাখ শিশু শিশুশ্রমের সঙ্গে জড়িত আছে। স্বল্প আয়ের পরিবারের কত মেয়ে শিশু যে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে, তার ইয়ত্তা নেই। তাছাড়া, অজ্ঞতা ও দরিদ্রতার জন্য বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের শিশুদের শৈশব উন্নয়ন সম্পর্কে কোনো ধারণা থাকে না। এ কারণে শিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর আগেই শিশুদের প্রস্তুতি এবং পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির জন্য অভিভাবকরা কোনো উদ্যোগ নেন না। এসব সমস্যা দূর করার জন্য সরকার প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে। তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুরা দুই বছরের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ পাবে। ১৯৯৩ সাল থেকে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ৬৭টি কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রাক-প্রাথমিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে। শিশুর প্রতি যেকোনো ধরনের সহিংসতা, নির্যাতন ও শোষণ বন্ধে জরুরি হেল্পলাইন খোলা হয়েছে। ১০৯৮ নম্বরে বিনামূল্যে শিশুরা সহায়তার জন্য যোগাযোগ করতে পারে। এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ১০৯ হটলাইন সেবাও রয়েছে। পথ থেকে ফেরাতে পথশিশুদের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য সরকারের পদক্ষেপটি প্রশংসনীয়। এছাড়া দেশের সুবিধাবঞ্চিত অনূর্ধ্ব ১৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা প্রাথমিক শিক্ষা দেয়া এবং দক্ষতা উন্নয়নের কাজ করছে। এর মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রলালয়ে শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যবস্থা করে থাকে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট ঢাকা বিভাগে ৬৫টি, বরিশাল বিভাগে ২৫টি, চট্টগ্রামে ১১টি, সিলেটে ৫টি, রাজশাহীতে ২২টি, রংপুরে ৪৭টি, খুলনায় ১৬টি ও ময়মনসিংহ বিভাগে ১৪টিসহ সারাদেশে ২০৫টি শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া করানো হয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজ সেবা অধিদপ্তরের সরকারি শিশু পরিবার বাবা-মা নেই বা বাবা নেই, এমন এতিম শিশুদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারি শিশু পরিবার পরিচালনা করছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের ছোটমণি নিবাসে বাবা-মায়ের পরিচয়হীন শূন্য থেকে সাত বছর বয়সী পরিত্যক্ত, পাচার থেকে উদ্ধার হওয়া শিশুদের লালন পালন ও সাধারণ শিক্ষা দেয়া হয়। বর্তমান সরকারের ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা ‘পথশিশুদের পুনর্বাসন ও নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা, হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল শিশুদের জন্য শিশু সদন প্রতিষ্ঠা এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা উন্নত ও প্রসারিত করা হবে’ সে অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে সরকার।
‘একটি শিশুও রাস্তায় থাকবে না, রাস্তায় ঘুমাবে না’- প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকার কাজ করছে। তবে, শিশু অধিকার বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ পরিবার ও রাষ্ট্রের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এ দায়িত্ব সবার, আমাদের এবং এ জন্য প্রয়োজন সমন্বিত প্রচেষ্টা ও অঙ্গীকার।
সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের উন্নত সুযোগ সুবিধা পৌঁছে দিতে একটি কল্যাণমুখী শিশুবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। শিশুবান্ধব বাজেট করতে হবে। শিশুদের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় বাজেটে শিশুদের জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখতে হবে আরও গুরুত্বের সঙ্গে। শিশুদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দিতে হবে। যথাসময়ে শিশুর জš§ নিবন্ধন করতে হবে। শিশুদের খেলাধুলা করার জন্য পর্যাপ্ত মাঠের ব্যবস্থা করতে হবে। শিশুর জন্য শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে শিশু দিবাযতœ কেন্দ্রের ব্যবস্থা চালু করতে হবে। শিশুদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য পরিবারের সচেতনতা ও সহযোগিতার পাশাপাশি পাড়া মহল্লা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত শিশুবান্ধব লাইব্রেরি স্থাপনের ব্যবস্থা করতে হবে, যেন আনন্দ সহকারে তারা লাইব্রেরিতে যেতে চায়। সর্বোপরি সব শিশুর সমান অধিকার রক্ষার্থে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, সরকার সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। প্রয়োজন শুধু নাগরিকদের এগিয়ে আসা এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া।
পিআইডি নিবন্ধ