সমতা স্কুল অ্যান্ড কলেজ

রাহাতুল ইসলাম: ছিন্নমূল শিশু-কিশোররা পড়বে বিনা খরচে। পাবে ভালো পরিবেশ। অভিজ্ঞ শিক্ষকরা করবেন পাঠদান। সমাজের বিত্তশালী মানুষের শিক্ষার যে পরিবেশ, সেটাও পাবে ছিন্নমূল শিক্ষার্থীরা। এজন্য তেমন কোনো খরচপাতিও নেই।  অবকাঠামো নির্মাণ, আসবাবপত্র তৈরি কিংবা বেতন-ভাতা দিয়ে শিক্ষক রাখায়ও নেই বাড়তি ঝামেলা। প্রয়োজন শুধু একদল শিক্ষানুরাগী মানুষের, যারা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে এগিয়ে আসবেন। সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের পাশে দাঁড়াবেন, এলাকাভিত্তিক গড়ে তুলবেন বৈকালিক শিক্ষা কার্যক্রম। এমন ভাবনা থেকেই ছিন্নমূল শিশু-কিশোরদের নিয়ে সমাজে ভারসাম্য আনতে ‘সমতা স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ ২০০০ সালের ২৩ এপ্রিল যাত্রা করে।

কীভাবে সুবিধাবঞ্চিত ছেলেমেয়েদের নিয়ে এ স্কুল ও কলেজের শুরু? জানতে চাইলে ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ (ইউডার) প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মুজিব খান বলেন, ছিন্নমূল ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুবিধার জন্য সাত শিক্ষক ও ১১ শিক্ষার্থী নিয়ে আমরা শুরু করেছিলাম। তিনি আরও বলেন, সরকারি কিংবা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই বিকালে বন্ধ থাকে। এসব প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারে ওই এলাকার ছিন্নমূল

শিশু-কিশোরদের বৈকালিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে। এখানে ওই এলাকার বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ পড়ূয়ারা এ শিক্ষা কার্যক্রমে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারেন। একই মানের শিক্ষা ও শিক্ষার পরিবেশ পাওয়ার মধ্য দিয়ে সমাজের উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের শিক্ষা অর্জনের সুবিধাগত যে ব্যবধান তা দূর হবে। সমাজের পিছিয়েপড়া শিশুরা সুশিক্ষার মাধ্যমে নিজেদের যেমন তৈরি করতে সচেষ্ট হবে, তেমনি ভবিষ্যতে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারায় সংযুক্ত থেকে সমাজে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।

সমতার অধ্যক্ষ মুনির আহমদ বলেন, শুরুতে কলেজ অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভের (কোডা) শিক্ষকরা এখানে শিক্ষক হিসেবে পাঠদান শুরু করেন। তারা স্ব-উদ্যোগে কোনো সম্মানী না নিয়ে এ সামাজিক কার্যক্রমে নিজেদের সম্পৃক্ত করেন। প্রতিদিন কোডার শিক্ষা কার্যক্রম শেষে বিকালে আড়াই ঘণ্টা সমতার ছেলেমেয়েদের পড়ান। বর্তমানে কোডা শিক্ষকদের পাশাপাশি সমতার শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন ইউডায় অধ্যয়নরত বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থী।

সমতার শিক্ষক ইউডার শিক্ষার্থী ফার্মেসি বিভাগের ছাত্রী জোবায়দা আক্তার বলেন, ছেলেমেয়েদের ইউডার ফান্ড থেকে বই-খাতা ও পোশাক কিনে দিই। টিফিন করাই। বিবিএ’র ছাত্র রতন বলেন, স্কুল অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ ও কলেজ অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভের শিক্ষার্থীদের যে পরিবেশে পাঠদান দেওয়া হয়, একই পরিবেশে প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত আমরা সমতার শিক্ষার্থীদের পড়াই। সমতার ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক শামীম শেখ বলেন, গাড়ির ড্রাইভার, পিয়ন, দারোয়ান, রিকশাচালক, দিনমজুর, গৃহপরিচারিকা, হকার প্রভৃতি পেশার মানুষের ছেলেমেয়েরাই আমাদের ছাত্রছাত্রী। ওদের কারও মা নেই, কারও নেই বাবা। কেউ অন্যের বাড়িতে কাজ করে। কেউবা হকার, কেউ আবার শপিংমল কিংবা রেস্টুরেন্টে খণ্ডকালীন কাজ করে।

বর্তমানে সমতায় প্রায় সাড়ে ৩০০ ছাত্রছাত্রী আছে। শিক্ষক আছেন ৩৮ জন। শিক্ষকরা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই এখানে শিক্ষকতা করছেন। সমতায় শিক্ষার্থীদের অভিভাবক হিসেবে মুখ্য ভ‚মিকা পালন করেন সামাজিক অভিভাবকরা। এ অভিভাবকদের অধিকাংশই সোডা, কোডা ও ইউডার শিক্ষক। তাদের টাকায় শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফি, ভর্তির টাকা ও অন্য শিক্ষা উপকরণ-ব্যয় মেটানো হয়। অভিভাবকহীন এসব শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি, ইউনিফর্ম, মাসিক টিউশন ফি, শিক্ষা উপকরণ ব্যয় প্রভৃতি কেউ বহন করতে চাইলে কিংবা আংশিকভাবে এসব খরচে অংশ নিতে চাইলে সে সুযোগও আছে। তবে টাকা-পয়সা দিয়ে শুধু অর্থনৈতিক দায়ভার নিলেই হয় না বরং নিজ সন্তানের ন্যায় অভিভাবক হিসেবে তাকে সব ধরনের, বিশেষ করে শিক্ষার অগ্রগতির খোঁজ-খবর রাখতে হবে। মাসে একবার স্কুলে এসে ওই বাচ্চাটির অভিভাবক হিসেবে

খোঁজ-খবর নিতে হবে। এছাড়া অভিভাবকদের যে সভা হয়, সেখানে তাকে অংশ নিতে হবে, যেন বাচ্চাটি তার অভিভাবক না থাকার শূন্যতায় না ভোগে। কোনো শিক্ষার্থী অভিভাবক হিসেবে কাউকে পেলে সোডা, কোডা, ইউডার প্রতিষ্ঠাতা, এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আগ্রহী শিক্ষকরা তাদের সামাজিক অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেন।

সমতায় স্কুল পর্যায়ে শিশু থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। কলেজ শাখাটি ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত। শিক্ষার্থীদের ন্যাশনাল কারিকুলাম টেক্সট বুকের পাঠ পরিকল্পনা অনুযায়ী পাঠদান করা হয়। এ পাঠদান প্রক্রিয়ায় সোডা ও কোডার শিক্ষা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো সপ্তাহে বাধ্যতামূলক ক্লাস টেস্ট। বছরে তিনটি সেমিস্টার। পরীক্ষার ফল প্রদান করে কোডার মূল্যায়ন বিভাগ। অধ্যাপক মুজিব খান এ স্কুল নিয়ে বলেন, ‘একটু ভালো পরিবেশ আর ভালো শিক্ষকের ছোঁয়ায় আমরা তাদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।’

সমতা স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এবার ২৩ ছাত্রছাত্রী এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। তাদের ২২ জনই পাস করেছে। এখান থেকে পাস করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন পেশায় তারা যুক্ত রয়েছে।

 

 

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০