দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দর কর্ণফুলী নদীর মোহনায় অবস্থিত। এ বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সম্পাদন হয় ৯২ শতাংশেরও বেশি। তাই কর্ণফুলী নদীতে নৌ-বাণিজ্য কার্যক্রম বজায় রাখতে নিয়মিত ড্রেজিং বা খনন করা প্রয়োজন। কিন্তু নানা জটিলতায় ব্যাহত হচ্ছে ড্রেজিংয়ের কাজ। এতে সংকুচিত হচ্ছে কর্ণফুলী, ভোগান্তিতে পড়ছে নগরবাসী। ফলে বন্দর ব্যবসায়ীরা গুনছেন আর্থিক লোকসান। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করে শেয়ার বিজ। এ নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব
সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: কর্ণফুলী নদীতে লাইটারেজ জাহাজ চলাচলের জন্য প্রায় ২৫০ কোটি টাকায় বন্দর কর্তৃপক্ষের ড্রেজিং কার্যক্রম চলমান। অন্যদিকে এক বছর ধরে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে শহরের জলাবদ্ধতা নিরসন, খাল পুনঃখনন ও সম্প্রাসারণে কাজ করছে। কিন্তু দুই সংস্থার সঙ্গে কাজের সমন্বয় না থাকায় ড্রেজিং প্রকল্পের প্রথম ৯ মাসে (অক্টোবর, ২০১৯) মোট অগ্রগতি ছিল ৩১ শতাংশ। পরের তিন মাসে (জানুয়ারি, ২০২০) মোট অগ্রগতি হয় ১৮ শতাংশ। অর্থাৎ ড্রেজিং করা এলাকা আবার ভরাট হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র কর্ণফুলী নদী। আর নদীর মোহনায় অবস্থিত চট্টগ্রাম বন্দর। এ বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সম্পাদন হয় ৯২ শতাংশেরও বেশি। এ বন্দরে আসা মাদার ভেসেল থেকে খালাস করা ভোগ্যপণ্য, শিল্পপণ্য, পাথর, ক্লিংকারসহ মোট ১০ কোটি ৩০ লাখ মেট্রিক টন কার্গো ১২০০ লাইটারেজ ভেসেলের মাধ্যমে কর্ণফুলীর নিকটে ১৮টি ঘাট ও দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবাহিত হয়। ফলে কর্ণফুলী নদীতে নৌ-বাণিজ্য কার্যক্রম বজায় রাখতে নিয়মিত ড্রেজিং বা খনন কাজ করতে হয়। কিন্তু নানা জটিলতায় ২০১৩ সালে শেষ হয়নি খনন কাজ। এর মধ্যে দীর্ঘদিন ড্রেজিংবিহীন থাকার কারণে অনেক পলি জমে নদীর বিভিন্ন অংশে চর জেগে ওঠে। পরে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কাজ শুরু করে। আর প্রকল্পের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত পলিথিনের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেন সংশ্লিষ্টরা। নদীর চার মিটার গভীরে মিলছে পলিথিন। ফলে ব্যাহত হয় কাজ। বদলাতে হয়েছে একাধিক ড্রেজার। আর এ কারণে পদে পদে ব্যাহত হচ্ছে ২৪২ কোটি টাকার প্রকল্প।
অপরদিকে চট্টগ্রাম নগরীতে ৭০ লাখ মানুষের বসবাস। নগরীর ৩৬টি খালের মুখে প্রতিরোধক কিংবা সøুইস গেট না থাকায় দৈনিক ২০ টন গৃহস্থালি ও পয়োবর্জ্য পড়ছে ‘অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ’-খ্যাত কর্ণফুলী নদীতে। কিন্তু সেবাপ্রদানকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয় না থাকায় ড্রেজিং করা এলাকাগুলো আবারও ভরাট হচ্ছে। বন্দরের অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়, ড্রেজিং প্রকল্পের প্রথম ৯ মাসে (অক্টোবর, ২০১৯) মোট অগ্রগতি ছিল ৩১ শতাংশ। পরের তিন মাসে (জানুয়ারি, ২০২০) মোট অগ্রগতি হয়েছিল ১৮ শতাংশ। ফলে সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
অন্যদিকে, এক দশকের বেশি সময় ধরে চট্টগ্রাম মহানগরের ৭০ শতাংশ এলাকায় নিয়মিত জলাবদ্ধতা থাকে বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে। কারণ এ নদীর ওপর নির্ভর করে চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগের বিষয়টিও। নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় পানি ধারণক্ষমতা যেমন হারিয়ে যায়, তেমনি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানি দ্রুত নামতেও পারে না। আবার জোয়ারের পানিতে চট্টগ্রামের নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়ে থাকে। এতে দুর্ভোগ কাটাতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে শহরের জলাবদ্ধতা নিরসন, খাল পুনঃখনন ও সম্প্রাসারণে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছে। এ প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ। অথচ এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে চলতি বছরে। এ প্রকল্পের আওতায় মোট ৩৬টি খালের মুখে প্রতিরোধক কিংবা ইউ গেট বানানোর কথা ছিল, যা এখন পর্যন্ত হয়নি। ফলে চট্টগ্রাম শহরের ৭০ লাখ মানুষের গৃহস্থালি বর্জ্য সরাসরি পড়ছে কর্ণফুলীতে। এতে ড্রেজিং করা এলাকাগুলো আবারও ভরাট হচ্ছে।
কর্ণফুলী নদীর ড্রেজিং দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় অনেক স্থানে পলি জমেছে। পাশাপাশি নদীর গভীরতাও অনেক কমেছে। এতে অনেক সময় নৌযান আটকে যাচ্ছে। এছাড়া অনেক সময় নৌ-দুঘটনায় ডুবে যাওয়া জাহাজগুলো তোলা হয়নি। সব মিলিয়ে ঝুঁকিতে আছে নৌযান চলাচল প্রক্রিয়া।
চট্টগ্রাম বন্দরের চিফ হাইড্রোগ্রাফার কমান্ডার এম আরিফুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ড্রেজিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নানা ধরনের জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। এর মধ্যে একটি ৩১টি খালের মুখে সøুইস গেট কিংবা বর্জ্য প্রতিরোধক না থাকায় ড্রেজিং করা এলাকাগুলো আবার ভরাট হচ্ছে। কারণ এসব খাল দিয়ে সরাসরি দৈনিক ২০ টন থেকে ২২ টন করে বর্জ্য কর্ণফুলীতে পড়ছে। অথচ জলাবদ্ধতা নিরসণে কাজ করছে সিডিএ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কাজ করছে চসিক। তাদের সঙ্গে সমন্বয় হচ্ছে না। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এক বৈঠকে জানা গেছে, বিদ্যমান খালের মুখে দ্রুত ঝলকপট নির্মাণ করা না হলে ড্রেজিংয়ের সুফল পাওয়া যাবে না। কারণ শহরের বর্জ্যগুলো সরাসরি নদীতে পড়ছে। এসব বিষয় নিয়ে আমরা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় দ্রুত একটা মিটিং কল করবে। তিনি বলেন, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম ৯ মাসে মোট অগ্রগতি ছিল ৩১ শতাংশ। কিন্তু পরের তিন মাসে জানুয়ারি পর্যন্ত মোট অগ্রগতি হয়েছিল ১৪ শতাংশ।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর সমন্বয় সভার আয়োজন করেছি। এ সমন্বয় সভায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক), পানি উন্নয়ন বোর্ড, চট্টগ্রাম ওয়াসা, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক), পরিবেশ অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার বিভাগ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, বিআইডব্লিউটিএ, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিল। আর চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৪ বি গ্রেড ইঞ্জিনিয়ারিং কোর। প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করার পর একবারও সমন্বয় সভা হয়নি। তবে জাতির স্বার্থে অবশ্যই নিয়মিত সমন্বয় সভা হওয়া উচিত, কারণ চট্টগ্রাম বন্দর আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ বন্দর।