Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 3:03 am

সমন্বিত উদ্যোগেই সফল হবে সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা

আবদুল মকিম চৌধুরী: উন্নয়নশীল দেশ হওয়ায় আমাদের আত্মনির্ভরশীলতা বাড়াতে হবে। বুদ্ধি ও কারিগরি বৃত্তিক কর্মসংস্থানের পাশাপাশি কায়িক শ্রমনির্ভর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। সবার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে নাগরিকরাও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী দেশের বোঝা নয়, সম্পদ। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বড় উৎস প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। বিদেশে আমরা যে শ্রমশক্তি পাঠাই, তাদের বেশিরভাগই কাজ করেন শ্রমিক হিসেবে। তাদের নিরোগ হওয়া জরুরি।

অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও সংক্রামক নয়, হƒদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার ও শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী অসংক্রামক রোগের প্রকোপ বাড়ছে। দেশে এখন মৃত্যুর প্রধান কারণ হƒদরোগ ও স্নায়ুতন্ত্রের রোগ। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (২০১১) প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০৩০ সাল নাগাদ যে কয়টা দেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষ বেশি বাস করবে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। 

২০৩০ সাল বৈশ্বিক উন্নয়নের একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা। ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল-এসডিজি) এবং ১৬৯টি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য এই সময়সীমা বৈশ্বিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সব বয়সী সব মানুষের সুস্থ জীবন ও ভালো থাকা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ১৩টি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। এর একটিতে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিরোধ ও চিকিৎসার মাধ্যমে অসংক্রামক রোগে মৃত্যু এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনতে হবে। এই সময়ের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে হবে এবং ভালো থাকার বিষয় এগিয়ে নিতে হবে।

সহস াব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যে (এমডিজি) অসংক্রামক রোগ বিষয়ে কোনো লক্ষ্য বা লক্ষ্যমাত্রা ধার্য ছিল না। তবে এসডিজিতে আছে। এমডিজি শেষ হওয়ার পর এসডিজির কার্যক্রম কাগজপত্রে ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে শুরু হলেও স্বাস্থ্য খাতে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি।

অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এসডিজি পরিকল্পনা, কার্যক্রম পরিচালনা ও পর্যবেক্ষণ করার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে একটি উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়েছে।

অসংক্রামক রোগের বোঝা: বিশ্বব্যাংকের ‘ট্যাকলিং নন-কমিউনিকেবল ডিজিজেস ইন বাংলাদেশ’  শীর্ষক প্রকাশনায় বলা হয়েছে, ২৩টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে হƒদরোগ ও ডায়াবেটিসে মৃত্যুর দিক থেকে বাংলাদেশ নবম স্থানে। এতে বলা হয়েছে, ৩০ বছর বা বেশি বয়সী হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের এক-তৃতীয়াংশ ডায়াবেটিস, ক্যানসার, হƒদরোগ বা শ্বাসতন্ত্রের জটিলতার রোগী। অন্যদিকে জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে সন্নিবেশিত তথ্য হলো, ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সাধারণ পরিষদে অসংক্রামক ব্যাধি-বিষয়ক আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন,  বৈশ্বিকভাবে ৬০ শতাংশ এবং বাংলাদেশে ৬১ শতাংশ মৃত্যুর কারণ হƒদরোগ, শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা, ক্যানসার ও ডায়াবেটিস।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রধান চারটি অসংক্রামক রোগ (ডায়াবেটিস, হƒদরোগ, ক্যানসার ও শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা) ছাড়াও আর্সেনিকোসিস, কিডনি রোগ, শ্রবণপ্রতিবন্ধিতা, থ্যালাসেমিয়া, অস্টিওপরেসিস নিয়েও তারা কাজ করে।

উচ্চ মাত্রায় তামাক সেবন, অপুষ্টি, কায়িক শ্রমে অনীহা, উচ্চ রক্তচাপ, এগুলো অসংক্রামক রোগ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। এর সঙ্গে বায়ুদূষণ, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জীবনযাপন প্রণালিতে পরিবর্তন অসংক্রামক রোগের বোঝা বাড়াচ্ছে।

এসডিজি-বিষয়ক জাতিসংঘ দলিলে বলা হয়েছে, অসংক্রামক রোগ টেকসই উন্নয়নের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। মানসম্পন্ন সেবা ও সেবার ক্ষেত্রে ন্যায্যতার যে কথা আমাদের দুর্ভাগ্য, এসডিজি দলিলে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ তা থেকে অনেক দূরে।

বিশেষজ্ঞরা তথ্যমতে, অসংক্রামক রোগের চিকিৎসাসেবা ব্যয় অনেক বেশি। অনেকে চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। প্রথমে শনাক্ত হয় উচ্চ রক্তচাপ, এরপর ডায়াবেটিস। ক্রমান্বয়ে হƒদরোগ, চক্ষুরোগ, কিডনিতে সমস্যা।

ডায়াবেটিস ক্রমেই সাধারণ মানুষের অতি দুর্ভোগের কারণ হয়ে উঠছে। বলা হচ্ছে, দেশ ওষুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু ওষুধের যা দাম, তা অনেকের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। 

সরকার কি পাঁচ বছর মেয়াদি স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত কর্মসূচির প্রকল্প দলিল তৈরি করছে। ২০১৭ সালে এ কর্মসূচির বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ-বিষয়ক কার্য পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে এসডিজি  মাথায় রেখে।

মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের উন্নতি এবং টিকাদানে আমাদের সাফল্য বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছে। অনেক দেশের কাছে বাংলাদেশ রোল মডেল। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা ভিন্ন। অসংক্রামক রোগের ব্যাপারে নেয়া পদক্ষেপ অপ্রতুল।

নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও বাজারজাত নিশ্চিত করা যায়নি। ভেজাল মানহীন খাদ্যে জনস্বাস্থ্য হুমকিতে রয়েছে।

নাগরিকরা স্বাস্থ্যসচেতন হতে হবে। এ ক্ষেত্রে বড় বাধা হলো উদাসীনতা ও আর্থিক অসামর্থ্য। 

এক. সঠিক খাদ্যাভ্যাস: শরীরের সঠিক যতœ একটি ভালো খাবার দিয়ে শুরু হয়। সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সব পুষ্টি উপাদান (কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, চর্বি, ভিটামিন এবং খনিজ), পানিসহ সুষম খাদ্য অপরিহার্য। ভালো খাদ্য অর্থ হলো, কীভাবে সঠিকভাবে খাবার বেছে নেয়া যায় এবং প্রস্তুত করা যায়। সঠিক জ্ঞানের মাধ্যমে, আমরা একটি সুষম খাদ্য পরিকল্পনা করতে পারি, যা বেশিরভাগ মানুষের নাগালের মধ্যে। এ ছাড়া আমরা আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে পারি এবং খাদ্যে কিছু উপাদান এড়িয়ে চলতে পারি। উদাহরণস্বরূপ, চিনি পরিহার করা আমাদের দাঁতের গহ্বর রোধ করতে সাহায্য করে। রক্তে কোলেস্টেরল (যা হƒদরোগের কারণ) নিয়ন্ত্রণ করতে, বয়স্ক ব্যক্তিদের খাবারে চর্বির পরিমাণ সীমিত করা উচিত।

দুই. ব্যক্তিগত এবং গার্হস্থ্য স্বাস্থ্যবিধি: আমাদের শরীর পরিষ্কার রাখতে হবে এবং পরিষ্কার পোশাক পরিধান করতে হবে। নিয়মিত গোসল করা উচিত এবং পোশাক পরিবর্তন করা উচিত। নিয়মিত গোসল না করলে বা জামাকাপড় না বদল করলে শরীর ও কাপড় থেকে দুর্গন্ধ হতে শুরু করে। এটি অণুজীবের বৃদ্ধির কারণে হয়। অণুজীব আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। নখ, চুল, দাঁত, হাত ও পায়ের দিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে। শৌচাগারে যাওয়ার পর সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধোয়া খুবই জরুরি। এ ছাড়া খাবার তৈরি ও পরিবেশনের সব পর্যায়ে পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।

গার্হস্থ্য স্বাস্থ্যবিধিতে, ঘর ও প্রাঙ্গণ পরিষ্কার এবং পোকামাকড় থেকে মুক্ত রাখা উচিত। অণুজীব আমাদের খাদ্যকে সংক্রমিত ও নষ্ট করতে পারে। তাই খাদ্যকে পোকামাকড় থেকে রক্ষা করতে হবে। বাসনকোসন ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে, বিশেষত কিছু ডিটারজেন্ট পাউডার বা ছাই দিয়ে।

তিন. পরিষ্কার খাদ্য: খাওয়া খাবার অণুজীব এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক যেমন কীটনাশক থেকে মুক্ত হওয়া উচিত। নির্দিষ্ট ধরনের অণুজীবের উপস্থিতি খাদ্য বিপজ্জনক এবং কিছু ক্ষেত্রে এমনকি মারাত্মকও হতে পারে। ফল ও সবজিতে সাধারণত অণুজীব এবং কীটনাশক ত্বকে লেগে থাকে। অতএব, খাওয়ার আগে বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ধোয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ।

চার. বিশুদ্ধ পানি এবং বায়ু: সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে পানীয় জল অবশ্যই পরিষ্কার এবং ব্যাকটেরিয়ামুক্ত হতে হবে। পাইপের মাধ্যমে সরবরাহ করা পানি সাধারণত পানীয়ের জন্য উপযুক্ত। কারণ সরবরাহ করার আগে এটি ফিল্টার করা হয় এবং জীবাণুনাশক দিয়ে নিরাপদ করা হয়। গ্রামীণ এলাকায় অস্বাস্থ্যকর সরবরাহ ব্যবস্থার কারণে উপলব্ধ পানি অনিরাপদ এবং অনেকগুলো পানিবাহিত রোগের কারণ হয়। পানিবাহিত রোগ এড়াতে, পান করার আগে পানি ফুটিয়ে এবং যথানিয়মে ছাঁকুনি দিয়ে ফিল্টার করা প্রয়োজন। পুকুরের পানি সাধারণত ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হয়। কাপড়-চোপড় ধোয়া বা এ ধরনের পুকুরে গোসল করলে অনেক রোগ হতে পারে। তাই এসব কর্মকাণ্ড পরিহার করতে হবে।

সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য বিশুদ্ধ বায়ুও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কর্মস্থল এবং বসতের জায়গায় ভালো বায়ু চলাচল করা উচিত। শিল্প, মোটরযান এবং বিভিন্ন স্থানে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে নির্গত গ্যাস পরিবেশকে দূষিত করে। দূষিত বায়ু দ্বারা শ্বাস নিলে দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ হয়। গ্রামীণ এলাকায়, মাটির চুলা প্রচুর ধোঁয়া উৎপন্ন করে, যা নারীদের স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলে। তাই যথাসম্ভব ধোঁয়াবিহীন চুলা ব্যবহার করা উচিত।

ব্যায়াম: সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য নিয়মিত ব্যায়ামও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বসে কাজ করেন এমন শ্রমজীবীদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ব্যায়াম পেশীগুলোকে শক্তসামর্থ্য করে, হাড়কে শক্তিশালী করে এবং ফুসফুস, হƒৎপিণ্ড এবং রক্তনালিগুলোকে ভালোভাবে কাজ করতে সহায়তা করে।

ঘুম ও বিশ্রাম: প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা সময়ে মানবশরীরের বেশ কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম প্রয়োজন। বিশ্রামের সময় শরীরের কোষগুলো দিনের কাজ থেকে পুনরুদ্ধার করে এবং পরবর্তী সময়ের কার্যকলাপের জন্য শক্তি সরবরাহ করে। তাই সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য নিয়মিত ঘুম এবং বিশ্রাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।

বিপজ্জনক পদার্থ এড়িয়ে চলা: তামাক, অ্যালকোহল এবং মাদকদ্রব্যের মতো কিছু বিপজ্জনক পদার্থ এড়িয়ে চলা সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। এসব পদার্থ শরীরের পাশাপাশি ব্যক্তির মনকে প্রভাবিত করে। সিগারেট ধূমপান ফুসফুসের ক্যানসারের কারণ। তামাক সেবনের ফলে মুখ, স্বরযন্ত্র এবং খাদ্যনালির ক্যানসারও হয়। ধূমপানের কারণে দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের রোগ হয় যার ফলে শ্বাসকষ্ট হয়। অ্যালকোহল মস্তিষ্ক, হƒৎপিণ্ড এবং পরিপাকতন্ত্র বিশেষ করে লিভারকে প্রভাবিত করে। মাদকদ্রব্যের অবৈধ ব্যবহার ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে।

রোগ প্রতিরোধ: শরীরকে বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা করার জন্য সব সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। বিশেষ করে শিশুদের সাধারণ রোগের বিরুদ্ধে টিকা দিতে হবে।

সঠিক শিক্ষা: নাগরিকদের প্রচেষ্টা এবং সঠিক স্বাস্থ্য শিক্ষার মাধ্যমে সুস্বাস্থ্য অর্জন করা যায়। জনস্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে এমন বিভিন্ন কারণ সম্পর্কে সচেতন হলেই সবাই সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সক্ষম হবে।

নাগরিকরা স্বাস্থ্যসচেতন নন। গুণগত মান নিয়ে উদাসীন। ওষুধ ও ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারক ও ব্যবসায়ীরা অসৎ, মুনাফালোভী। মুরগি ও গো-খাদ্যে চামড়ার বিষাক্ত বর্জ্য মিশ্রণ করা হয়। সরিষা, সয়াবিন, পামঅয়েল কোনোটিই বিশুদ্ধ নয়। মধু, ঘি, দুধ শতভাগ খাঁটি কি না, সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে। আজকাল গাভি দোহনের সময় ক্রেতা গিয়ে বসে থাকেন, খাঁটি দুধ পাওয়ার জন্য! তাই নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, জাতীয় মান সংস্থা, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থাকে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তত্ত্বাবধানে ‘হেলথ ফর অল’  বা ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ নিশ্চিতকরণে ১৯৭৮ সালে কাজাখস্তানের আলমাআতা শহরে সবার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বা প্রাইমারি হেলথ কেয়ার (পিএইচসি) পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়। আলমাআতা ঘোষণার মূল তত্ত্বই ছিল স্বাস্থ্যসেবাকে সর্বজনীন করে একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলা। সেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২০০০ সাল পর্যন্ত। সম্প্রদায়ভুক্ত সবার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহযোগিতা, সব খাতের সমন্বয়, যথোপযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের বিষয়টিও সেখানে উল্লেখিত হয়েছিল। এ ছাড়া মূলনীতিতে এসেনসিয়াল হেলথকেয়ার বা অতি প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়েছিল। কিন্তু ২০০০ সালের মধ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সন্তোষজনক লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। জাতিসংঘ এমডিজি ঘোষণায়ও আটটি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে শিশু, মাতৃস্বাস্থ্য ও রোগব্যাধির বিষয়টিকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেয়া হয়।

এমডিজি অর্জনে আমাদের বিশেষ সাফল্য আছে। স্বাস্থ্য খাতে এ অগ্রগতি এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে মডেল হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতিও পেয়েছে। তবে সবার জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার বিষয়টি সুদূর পরাহতই রয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে কভিড পরিস্থিতি আমাদের বুঝতে সহায়তা করেছে, স্বাস্থ্যের বিষয়টি কতটা প্রয়োজনীয়।

বর্তমানে পরিবেশদূষণ, বিষাক্ত খাদ্যগ্রহণ, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার পরিবর্তনের ফলে আশঙ্কাজনকহারে বিভিন্ন রোগের বিস্তার ঘটছে। বিশেষ করে বাড়ছে ক্যানসার, ডায়াবেটিস, হƒদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক এবং কিডনি সমস্যাসহ অন্যান্য দুরারোগ্য ব্যাধি। চিকিৎসা হয়ে উঠছে অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্য ওষুধ, যন্ত্রপাতি ও অবকাঠমো তৈরিতে বিপুল অর্থ খরচ করা হচ্ছে। এমনকি রোগী সুস্থ হলেও রোগী ও তার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

স্বাস্থ্য সেবাদানের ক্ষেত্রে সরকারি ব্যবস্থায় বিভিন্ন কারণেই সুশাসনের অভাব আছে। সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে যথার্থ মানবিক গুণসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন একটি স্বচ্ছ সাংগঠনিক ব্যবস্থা ও দায়বদ্ধ প্রশাসন। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে কোনোভাবেই দায়বদ্ধ প্রশাসন বলা যায় না। নাগরিকরা নিজে ব্যক্তি উদ্যোগে ভালো থাকার চেষ্টা করতে পারে কিন্তু কিছু দায়িত্ব রাষ্ট্রকে পালন করতে হয়। এখন মানহীন ওষুধ এবং ভেজালমুক্ত খাদ্যের ছড়াছড়ি। তাই দুরারোগ্য ব্যাধি ঠেকানো বা নিয়ন্ত্রণ কর দুঃসাধ্যই বটে। সুস্বাস্থ্য শুধু রোগ চিকিৎসার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বিশুদ্ধ পানী, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, দূষণমুক্ত পরিবেশ এবং মানসম্মত ওষুধ প্রভৃতি প্রয়োজন।  স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় রোগ চিকিৎসা এবং কিছু প্রতিরোধমূলক কর্ম সম্পাদনসহ চিকিৎসা শিক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত। স্বাস্থের অন্যান্য উপাদানের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণে স্থানীয় সরকার বিভাগ, খ্যাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রভৃতির সম্পৃক্ততা রয়েছে। তাই সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সফল করতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

সাংবাদিক

amchy9@yahoo.com