শেয়ারবাজারের উত্থান-পতন স্বাভাবিক বিষয়। এটি সব দেশেই ঘটে থাকে। গতকাল শেয়ার বিজে প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদন পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকবে। একটি হলো ‘ডিএসইতে দৈনিক গড় লেনদেন কমেছে ২৬ দশমিক ১৫ শতাংশ’। অন্যটি হলো ‘দশকের মধ্যে খারাপ সপ্তাহ পার করল মার্কিন পুঁজিবাজার’। প্রথম প্রতিবেদনে বলা হয়, পুঁজিবাজারে গত সপ্তাহে সূচকের মিশ্র প্রবণতা থাকলেও দৈনিক গড় লেনদেন কমেছে ব্যাপক হারে। তবে বেশিরভাগ শেয়ারের দর ইতিবাচক অবস্থানে ছিল। গত সপ্তাহে এক কার্যদিবস লেনদেন কম হওয়ায় বড় ব্যবধানে কমেছে মোট লেনদেন। তবে বাজার মূলধন ইতিবাচক অবস্থানে ছিল। গত সপ্তাহে চার কার্যদিবস লেনদেন হয়। আগের সপ্তাহে পাঁচ কার্যদিবস লেনদেন হয়। এর মধ্যে তিন দিন সূচক বেড়েছে, কমেছে একদিন। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) সব সূচক ইতিবাচক অবস্থানে ছিল। তবে লেনদেন কমেছে ব্যাপক হারে। বেড়েছে বেশিরভাগ শেয়ারের দর। দ্বিতীয় প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ, সুদহার বৃদ্ধি এবং সম্ভাব্য শাটডাউনের প্রভাব পড়েছে মার্কিন পুঁজিবাজারে। গত শুক্রবার দেশটির প্রধান তিন সূচকে বড় পতন হয়েছে। সব মিলিয়ে এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সপ্তাহ পার করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজার।
শেয়ারবাজারের উত্থান-পতন স্বাভাবিক এবং এটি যুক্তরাষ্ট্রের মতো সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশেও হয়ে থাকে। অবশ্য সব দেশেই এমনটি হয়ে থাকে। কিন্তু অন্য দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের মৌলিক তফাত এই তারা সচেতন হয় এবং পতন রোধে ব্যবস্থা নেয়। আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিলেও তা তেমন সুফল বয়ে আনে না। ফলে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারান। শেয়ারবাজারকে দীর্ঘ মেয়াদে চাঙা রাখতে উদ্যোগ দেখা যায় না। আন্তর্জাতিক শেয়ারবাজারের নেতিবাচক প্রভাবই পড়ে আমাদের শেয়ারবাজারে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারে পতন হলে আমাদের বাজারেও পতন হয়; কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজার ঘুরে দাঁড়ালে কিংবা চাঙা হলে আমাদের বাজার চাঙা হয় না।
কিছুদিন আগে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘বাংলাদেশে এখনও শক্তিশালী পুঁজিবাজার গড়ে ওঠেনি; তবে শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশ নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। কারণ, ভিত্তি শক্তিশালী হলে পুঁজিবাজারে তা দৃশ্যমান হয়। কিন্তু এখনও এ বাজারের সুফল পাচ্ছেন গুটিকয়েক বড় বিনিয়োগকারী। এটি সর্বজনীন হয়ে ওঠেনি। পুঁজিবাজারের প্রাণ সাধারণ বিনিয়োগকারী। তাদের সুরক্ষা এবং তাদের বাজারে ধরে রাখতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলে অভিযোগ বিনিয়োগকারীদের।
শেয়ারের চাহিদা শক্তিশালীকরণ, মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির তালিকাভুক্তি, ব্রোকারেজ হাউজের শাখা বৃদ্ধি, শর্ট সেল বন্ধ করাসহ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগে বাজার পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে বলে এ খাতের বিশেষজ্ঞদের অভিমত। বাজার পড়ে গেলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট অংশীজন নড়েচড়ে বসে। এরপর কাজে ধারাবাহিকতা থাকে না; থাকে না নজরদারিও। ফলে পুুঁজিবাজার পরিস্থিতি সাময়িক মোকাবিলা করা গেলেও সমস্যা থেকেই যায়।
দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা লক্ষাধিক। এর মধ্যে কয়েক হাজার কোম্পানির শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা আছে। কিন্তু আমাদের তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা এখনও ৪০০ অতিক্রম করেনি। বাজার চাঙা করতে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ও মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির তালিকাভুক্তি, মোবাইল ফোন অপারেটর এবং ইউনিলিভার ও নেসলের মতো ব্যাপক মুনাফা অর্জনকারী বহুজাতিক কোম্পানিকে বাজারে আনতে হবে। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করতে সুস্পষ্ট তাগিদ ও নির্দেশনা দিতে হবে। আর বহুজাতিক কোম্পানির তালিকাভুক্তি নিশ্চিতে যথাযথ আইনি সংস্কার প্রয়োজন।
শেয়ারবাজার অবকাঠামোর টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে মানসম্মত ও লাভজনক করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে বাজারে তালিকাভুক্ত করতে আইনি বাধ্যবাধকতা, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সমন্বয় ও আর্থিক প্রণোদনা নিশ্চিতের লক্ষ্যে কৌশল প্রণয়ন করতে হবে।
শেয়ারবাজার শক্তিশালীকরণে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পুঁজিবাজার বিশেষ ধরনের প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এটির ভূমিকা যাতে আরও জোরদার করা যায়, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বিনিয়োগকারীদেরও উচিত গুঞ্জন-গুজবে প্রভাবিত না হয়ে মেধা খাটিয়ে ভালো মানের কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করা। নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ অংশীজনের সমন্বিত পদক্ষেপে শেয়ারবাজার স্থিতিশীল হবে বলেই প্রত্যাশা।