Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 9:05 pm

সময়ের পরিক্রমায় বিলুপ্ত পেশা ভিস্তিওয়ালা

ভিস্তি শব্দটি সর্বপ্রথম খুঁজে পাই রবীন্দ্রনাথের জুতা আবিষ্কার কবিতায়। কবিতার পঙ্ক্তি দুটি ছিল

তখন বেগে ছুটিল ঝাঁকে ঝাঁক

মশক কাঁখে একুশ লাখ ভিস্তি।

তখন মনে প্রশ্ন জেগেছিল যে ভিস্তি শব্দের অর্থ কী? আমরা ‘ওয়ালা’ শব্দাংশ যুক্ত বিভিন্ন পেশার নাম জানি। যেমনÑফেরিওয়ালা, রিকশাওয়ালা, ডাব্বাওয়ালা। তবে বর্তমান প্রজšে§র অনেকেই আছেন ‘মশক’ ও ‘ভিস্তিওয়ালা’ শব্দ দুটির সঙ্গে পরিচিত নন। মূলত জল বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহƒত ছাগলের চামড়ার তৈরি এক বিশেষ ধরনের ব্যাগ যা ‘মশক’ নামে পরিচিত। এ মশকে করে যে ব্যক্তি জল বহন এবং শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সরবরাহ করতেন, তিনি ভিস্তিওয়ালা নামে পরিচিত। ফারসি শব্দ ‘বেহেশত’ হতে ভিস্তি শব্দটি এসেছে। বেহেশত শব্দের অর্থ স্বর্গ। পশ্চিম এশিয়ার সংস্কৃতি অনুযায়ী আগের দিনের মানুষ মনে করত, স্বর্গে প্রচুর নদী, খাল, পুকুর রয়েছে। তাই একসময় মানুষের বিশ্বাস ছিল স্বর্গীয় নদী থেকে ভিস্তিরা মশকে করে ঠাণ্ডা জল নিয়ে এসে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতেন।

আগের যুগে নিরাপদ পানির একমাত্র উৎস ছিল নদী, পুকুর, কুয়া প্রভৃতি। তবে এসব ছিল লোকালয় থেকে দূরদূরান্তে। শহরবাসীর জন্য পানি সংগ্রহ করা ছিল ভীষণ কষ্টসাধ্য। তাই শহরবাসীর কষ্ট লাঘব করতে দ্য লাস্ট ওয়াটার ম্যান খ্যাত ‘ভিস্তি’ নামীয় পেশার উৎপত্তি। ভিস্তিওয়ালাদের কাঁধে ঝুলানো থাকত গাঢ় বাদামি রঙের ব্যাগ যাকে মশক বলা হতো। ১০ থেকে ২০ টাকার বিনিময়ে ভিস্তিওয়ালারা কলকাতা শহরের লোকদের এক মশক পানি সরবরাহ করে দিতেন। এক মশকে থাকত ৩০ লিটার পানি। জল নেবেন গো জল, ভিস্তিওয়ালার ঠান্ডা জল।”অথবা ভিস্তি আবে ভিস্তি এমন হাঁক-ডাক দিয়ে বাড়ি বাড়ি তারা পানি সরবরাহ করতেন। কলকাতার পাশাপাশি ঢাকা শহরেও ভিস্তিওয়ালাদর আবির্ভাব ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীতে। এমনকি পুরান ঢাকার সিক্কাটুলিতে ভিস্তিপল্লী গড়ে উঠেছিল। স্থানীয়ভাবে তারা সাক্কা নামে পরিচিত ছিল। এই সাক্কারা ছিল সুন্নি মুসলিম। কলকাতা ও ঢাকার ভিস্তি পল্লীগুলো ছিল আলাদা। ১৮৩০ সালে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট হেনরি ওয়াল্টারস এক আদমশুমারিতে ১০টি ভিস্তিপল্লীর উল্লেখ করেছিলেন।

২০১১ সালে প্রকাশিত লেখক হূমায়ুন আহমেদের ইতিহাসভিত্তিক ‘বাদশাহ নামদার’ উপন্যাসে উল্লেখ আছে, ১৫৩৯ সালে মুঘল সম্রাট হুমায়ুুন চৌসার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ঘোড়াসহ ঝাঁপ দিয়েছিলেন এক খরস্রোতা নদীতে। জলের প্রবল স্রোতে যখন তিনি জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে, ঠিক তখন নাজিম নামে এক ভিস্তিওয়ালা তার মশকে বায়ুু ভর্তি করে দেন। হুমায়ুন বায়ু ভর্তি মশকে ভর করে সাঁতরে উঠেছিলেন। এছাড়া, আগের দিনে যুদ্ধের সময় জল রাখার জন্য এ মশক ব্যবহার করা হতো।

সভ্যতার উন্নয়নের সঙ্গে কালের বিবর্তনে আগের অনেক পেশা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তেমনি ১৯৬৩ সালে ঢাকা ওয়াসা প্রতিষ্ঠিত হলে ধীরে ধীরে শহরবাসীর পানির কষ্ট লাঘব হয়। ১৯৬৮ সালে ঢাকায় ভিস্তিদের পেশাদারি জীবনের সমাপ্তি ঘটে। শোনা যায়, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় ভিস্তিদের দেখা গিয়েছিল। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভিস্তিরা এখন যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন পেশায়। তবে কলকাতার রাস্তায় নাকি আজও ভিস্তিদের দেখা পাওয়া যায়। যদিও এখন তাদের উপার্জন নগণ্য। কারণ এখন যানবাহন, রাস্তাঘাট, বাসা, রেস্টুরেন্ট সর্বত্র সুপেয় পানির ব্যবস্থা রয়েছে। তবুও কিছু সংখ্যক ভিস্তি তাদের বংশগত ঐতিহ্য বহাল রাখার জন্য এ পেশায় নিয়োজিত রয়েছে। তাদের সংখ্যা হাতে গোনাÑ৪০ জন হবে। কলকাতার বৃন্দাবন দাস লেন, মারকুইস স্ট্রিট, ইলিয়ট রোড, রাফি আহমেদ কিদোয়াই রোড এসব স্থানের কিছু সংখ্যক বাড়ি ও দোকানে ভিস্তিরা দুবেলা জল দিয়ে আসে।

বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে নিত্যনতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার হচ্ছে এবং মানুষের ভোগান্তি কমছে। সেই সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে মানুষের পেশা। কেননা আগে যেসব পেশায় মানুষ নিয়োজিত ছিল, সেসব পেশার বিকল্প যন্ত্র, পদ্ধতি, কৌশল প্রভৃতি আবিষ্কার হওয়ায় মানুষের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি বাসায় রেফ্রিজারেটর রয়েছে। মানুষ চাইলেই হাতের কাছে ঠাণ্ডা পানি পাচ্ছে যা আগে ছিল না। মোটর পাম্প আবিষ্কার করা হয়েছে যা দিয়ে মাটির নিচ থেকে ওপরে পানি উত্তোলন করা হয়। তেমনি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভিস্তিওয়ালাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। তাদের পেশা বিলুপ্ত হয়ে গেছে কিন্তু তাদের পেশাদারি জীবন পরিক্রমার গল্প রয়ে যাবে ইতিহাসের পাতায়।

রুহানা আক্তার বৃষ্টি

শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়