Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 11:24 pm

সমাজের প্রতিচ্ছবি ম্যাওসংকেত্তনে

মোড়ল ইঁদুর দরবারে এসেছেন মাত্র। সাধারণ ইঁদুরের মতো ম্যাও অর্থাৎ বিড়ালকে একটু বেশিই ভয় করে চলেন তিনি। তাই আশেপাশে যখন ম্যাও ডাকে তখন জড়সড় হয়ে বসেন। প্রতিদিনই তার দরবারের বিভিন্ন দিক থেকে ম্যাও ম্যাও শব্দে ভয় দেখানো হয়। কিন্তু বুঝতে পারেন না আসলেই বিড়াল না-কি কেউ বিড়াল সেজে ভয় দেখাচ্ছে। তাই বিড়াল দমনের জন্য রেখেছেন দফাদার। আছেন দফতর প্রধানও। মোড়লদারি দেখাশুনার দায়িত্বে তারাই। দফাদারের কাজ এলাকার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা। আর দাফতরিক কাজকর্ম দফতরির দায়িত্বে। দুজনেরই মোড়লের চেয়ারের প্রতি রয়েছে লোভ। সময় পেলেই মোড়লকে ভয় দেখানোর কাজ করে তারা। মোড়লকে বোঝানো হয়, সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী গেছো তাকে ভয় দেখায় প্রতিনিয়ত। ধরে এনে বেঁধে রাখা হয় গেছোকে। তারপরও তাকে ভয় দেখানো অব্যহত রয়েছে। দেশের ক্ষমতা ধরে থাকার চাহিদা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নিজের প্রয়োজনে যে কাউকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আসল অপরাধীদের ধরা সম্ভব হচ্ছে না। আসলে যারা আমাদের আশেপাশে দুর্ঘটনা বা অস্থিরতা ছড়াচ্ছে তাদের আমরা ধরতে পারছি না। প্রতীকী ইঁদুর বিড়ালের অভিনয়ে এমন একটি নাটক মঞ্চায়ন হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রতীক হিসেবে ইঁদুর-বিড়ালের কাহিনী দেখানো হলেও নাটকে ফুটে উঠেছে বর্তমান সমাজের প্রতিচ্ছবি। দেখানো হয়েছে

আইনব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, গণমাধ্যমের অবস্থাসহ সমাজের বিভিন্ন দিক।

‘ম্যাওসংকেত্তন’ নাটকটি মঞ্চে এনেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুশীলন নাট্যদল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মলয় ভৌমিক নির্দেশিত নাটকটির ‘ম্যাওসংকেত্তন’ নামটি স্বার্থক বলছেন দর্শকেরা। নাটকে বার্তা দেওয়া হয়েছে, আজকে সমাজকে নিয়ে যে ব্যক্তি চিন্তা করছে, সমাজের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে কথা বলছে, পরিবর্তন নিয়ে ভাবছে, প্রতিরোধ গড়ে তুলছে তাদের দমনের চেষ্টা করা হচ্ছে। যেখানে সমাজের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ নিলেই তাকে দমন করার পথ খোঁজা হয়। তৈরি করা হয় আইন। আইনের শাস্তিও বেশ কঠোর। প্রয়োজন মতো যখন যে আইনের পরামর্শ দিচ্ছেন সে রকম আইন তৈরি করা হচ্ছে। দেখানো হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থাওÑমুক্তবুদ্ধির চিন্তা করে সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়াকে ভালোভাবে মেনে নিচ্ছে না আজকের সমাজ। সার্টিফিকেট পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীলতা হারিয়ে যাচ্ছে। দেখানো হয়েছে, সমাজের বড় বড় স্থানগুলো যারা দখল করে আছে তারা সঠিক মানুষকে মর্যাদা দিতে চায় না। আশপাশে এমন মানুষদের বসানো হয়েছে যাদের ভালো মন্দ বিবেচনা না করেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে তাদের পরামর্শ। মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে নিজস্ব চাহিদাকে। সব স্তরেই দুর্নীতি হচ্ছে, সেগুলো দেখা হচ্ছে না। যারা গদি ধরে বসে আছে তারা গদি ছাড়তে চাইছে না। সমাজ চলে যাচ্ছে অপসংস্কৃতির দ্বারপ্রান্তে।

গণমাধ্যমের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে টকশোর মাধ্যমে যেখানে বিজ্ঞাপনের মাত্রা এত বেশি যে সাধারণ জনগণ সেখানে উপেক্ষিত। গণমাধ্যমে সাধারণ জনগণ গুরত্বহীন হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে গণমাধ্যম আয়োজিত টকশোতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিষয়গুলো উপস্থাপন করেছেন এমনও লোক আছেন যারা বিষয়টি সম্পর্কে কোনো ধারণা রাখেন না।

সমাজের এই অসঙ্গতি বিভিন্ন কারণেই হচ্ছে। কিন্তু যাদের কারণে এতসব হচ্ছে তাদের ধরা যাচ্ছে না। যদিও বিষয়গুলো প্রতীকী ইঁদুর বিড়ালের মাধ্যমেই দৃশ্যমান। তবু এমন এক বার্তা ম্যাওসংকেত্তন দিচ্ছে, যা আমাদের উপলদ্ধির বিষয়ও বটে। মঞ্চায়িত নাটকটিতে সমাজের প্রকৃত রূপ এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে একজন মানুষ সহজেই নাটকের ভাষা বুঝতে পারবেন। দলের প্রদর্শনী আর সদস্যদের প্রচেষ্টায় এমন আয়োজন করে যাচ্ছে অনুশীলন। দর্শকরা বলছেন, সমাজের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে অনুশীলন নাট্যদলের এমন সৃজনশীল আয়োজনকে যে কোনো ধরনের সহযোগিতার মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। গত ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে নাটকটি প্রদর্শিত হয়েছে।

 

চন্দ্রবিন্দু, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়