সমাজ, রাষ্ট্র ও জনমত গঠনে গণমাধ্যমের ভূমিকা

শহীদুল ইসলাম শুভ: আধুনিক সময়ে গণমাধ্যমের প্রভাব ও গুরুত্ব অনেক বেশি। সাধারণ মানুষের কাছে খবর বা তথ্য দ্রুত পাঠানোর মাধ্যম হলো গণমাধ্যম। গণমাধ্যমে যিনি কাজ করেন তাকে বলা হয় গণমাধ্যমকর্মী বা সাংবাদিক। একটা সময় গণমাধ্যম ছাড়া কোনোকিছু কল্পনাও করা যেত না। কিন্তু এ সময়ে স্মার্টফোন দিয়ে যেকোনো ঘটনা যে কেউ ভিডিও বা লাইভ করে দেখিয়ে থাকেন। তবুও আমরা অপেক্ষায় থাকি বিশ্বস্ত কোনো মিডিয়া বা গণমাধ্যমে তা প্রচার হয়েছে কি না। সুতরাং আধুনিক সময়েও গণমাধ্যম যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি রয়েছে বড় ভূমিকা।

জনমত বলতে সাধারণত জনগণের মতামতকে বোঝায়। আর গণমাধ্যম বলতে বোঝায় সংবাদপত্র, বেতার, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, প্রচারপত্র ও ব্যঙ্গচিত্র। সমাজ ও রাষ্ট্রে এগুলোর আলাদা আলাদা প্রভাব রয়েছে। মানুষ এখনও বেতার শোনে এবং স্মৃতিকাতর হয়। সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের প্রভাবটা সবচেয়ে বেশি। তাই এগুলোকে শুধু ব্যবসাকেন্দ্রিক হলে হবে না, হতে হবে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ। গণমাধ্যম যেমন পারে একটা দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে, তেমনি পারে ধ্বংস করতে। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো ইরাক ও সিরিয়ার প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়েছিল এবং ভুয়া তথ্য দিয়ে সেই দেশগুলোর গঠনতন্ত্রকে নষ্ট করে দিয়েছিল। সেটা শুধু সম্ভব হয়েছে মিথ্যা আর গুজব ছড়িয়ে গণমাধ্যম দ্বারা। গণমাধ্যমের তথ্যের কারণে একটা জাতি ও দেশ বিশ্বের দরবারে যেমন হয় সম্মানিত, তেমনি হতে পারে কলঙ্কিত।
সংবাদপত্র হলো একটা দেশ, সমাজ ও জাতির মুখপাত্র। একটা দেশের জাতি কতটা বাকস্বাধীনতা ভোগ করে, তা গণমাধ্যমকে দেখলেই বোঝা যায়। সেজন্য একজন স্বাধীন ও মুক্তমনা সাংবাদিককে তথ্যের জন্য কঠিন ও কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, ত্যাগ স্বীকার করতে হয় এবং দুরন্ত ও সাহসী হতে হয়। অনেক সময় তারা সাহসিকতার বা ভয়ের কারণে সত্য নিউজ করতে চান না। অন্যায় নিপীড়ন ও দুর্নীতি দেখেও চুপ থাকেন। পরিবারের কথা ভেবে অনেকে চুপসে যান। ফলে সত্য থেকে যায় আড়ালে। প্রকৃতপক্ষে একজন সৎ ও সাহসী সাংবাদিক কখনও সত্যকে আড়াল করতে পারেন না। তারা কখনও লোকভয় ও রাজভয় করেন না। সব সময় তারা অনুসন্ধানী হন।

দেশ-বিদেশে এমন অনেক সাংবাদিক রয়েছেন, যারা সত্য চাপিয়ে যেমন আলোড়ন তৈরি করেছিলেন, তেমনি তাদের জীবনও দিতে হয়েছিল। বব এডওয়ার্ড, সেন্ড লুইস পেস্ট ডিসপ্যাচ, উইল ফ্রেড ব্রুচেট, পিটার আর্নেস্ট, জন পিটার, এলিজা প্যারিস লডজয়, মার্গারেট ব্রুক হোয়াইটসহ প্রমুখ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকর্মীরা বিখ্যাত হয়ে আছেন সত্য প্রকাশের জন্য। বাংলাদেশেও অনেক দুরন্ত সাহসী সাংবাদিক ছিলেন, যারা ’৫২-র ভাষা আন্দোলন থেকে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধেও ভূমিকা রেখেছিলেন। তাদের মধ্যে জহুর হোসেন চৌধুরী, মাওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ, আব্দুস সালাম, আবু জাফর, এবিএম মুসা প্রমুখ গণমাধ্যমের সাহসিকতার প্রতীক হিসেবে অমর হয়ে আছেন। জেল, হামলা-মামলার শিকার হলেও তারা পিছপা হননি।
গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে সংবাদপত্র সবচেয়ে বেশি সময় ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। একটা সময় বলা হতো, ‘সংবাদপত্র ছাড়া একটা দিনও কল্পনা করা যায় না।’

দেশ-বিদেশের নানা ঘটনা সকালবেলায় মানুষ ঘরের দরজার কাছে পেত; শুধু দেশ-বিদেশের ঘটনা যে তা নয়, বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক আমলা, শিক্ষক ও সাংবাদিকদের বৈচিত্র্যপূর্ণ বিশ্লেষণ পড়ে ধারণা করত ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে। এখনও মানুষের ঘরে সংবাদপত্র বিলি হয়। এই সংবাদপত্র যদি সঠিক তথ্য না ছাপায়, তাহলে মানুষের কাছে ভুল তথ্য পৌঁছাতে পারে এবং যেকোনো দুর্ঘটনা করতে পারে। আবার সত্য ছাপানোর ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি হতে পারে। তাই ঘটনা বর্ণনার সময় রিপোর্টার ও সম্পাদককে সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ে সংযত ও সজাগ থাকতে হবে।

টেলিভিশন হলো আধুনিক সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী ও দ্রুত গণমাধ্যম। সংবাদপত্র যেখানে এক দিনের ঘটনা পরের দিনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়, সেখানে টেলিভিশন সরাসরি লাইভেও দেখানো যায়। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রে এর প্রভাব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। জনমত গঠনে টেলিভিশন সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। কোথাও কোনো আন্দোলন বা দুর্নীতি করলে, বিশ্বস্ত সূত্রে টেলিভিশনে দেখলে মানুষ দ্রুত ঐক্যবদ্ধ হয় এবং জনমত গঠন করে। টেলিভিশনেও সংবাদপত্র পরিবেশন করা হয় এবং বিনোদনমূলক ও শিক্ষামূলক অনেক কিছু পাওয়া যায়। ফলে মানুষ এটার প্রতি ঝুঁকেও বেশি। একটা সময় শহরে টেলিভিশনের প্রভাব বেশি হলেও আজকাল এই ব্যয়বহুল কিছুটা কম হওয়ায় গ্রামীণ জীবনেও মানুষ টেলিভিশন ব্যবহার করতে পারছে।
বেতারে আজকাল তেমন দর্শক পাওয়া যায় না।

তবুও অনেক মানুষ বেতারের খবরের জন্য অপেক্ষা করে। কেননা সংবাদপত্র পড়ার জন্য অক্ষর জ্ঞানের প্রয়োজন পড়ে। আর টেলিভিশন ব্যয়বহুল হাওয়ায় সবার বাসাবাড়িতে তেমন পাওয়া যায় না। ফলে নিরক্ষর মানুষরা সবসময় বেতারের অপেক্ষা করে। বেতার কতটা শক্তিশালী ১৯৭১ সালের যুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে। এই বেতারের জন্যই আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। বেতারের খবরের জন্য জনমত গঠন সম্ভব হয়েছিল। সমাজের মানুষেরা বেতারের খবরের জন্য সচেতন ও সজাগ ছিল। খবর শুনে তারা জনমত গঠন করেছিল এবং আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন বাংলাদেশ।

চলচ্চিত্র ও ব্যঙ্গচিত্র মানুষের মনে দাগ কাটে। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে যেমন সংস্কৃতি ও কৃষ্টি সম্পর্কে সম্মক ধারণা পাওয়া যায়, তেমনি রাজনৈতিক বিষয়াদিও তুলে আনা হয়। ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমও মানুষকে জনমত গঠনে সচেতন করতে সহযোগিতা করে। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের যে চিত্র এবং পাকিস্তানের শাসক আইয়ুব খানের ব্যঙ্গচিত্র বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। গণমাধ্যমকর্মী ও গণমাধ্যমের কাজই হলো সব তথ্য তুলে ধরা। যেখানে অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, শোষণ ও নিপীড়ন হয়, সেগুলো তুলে এনে সংস্কার করা। কোন দল বা কারও নামে চাটুকারিতা না করা। বড় বড় রাঘব বোয়ালের চিত্র তুলে ধরে মুখোশ খুলে দেয়া। একজন আদর্শবান সাংবাদিক সব সময় দেশ ও জাতির চিন্তা করেন এবং জাতি ও দেশের জন্য নিজের জীবন বাজি রাখেন।

ভুল নিউজের জন্য অনেক সময় অসাম্প্রদায়িকতাও ছড়িয়ে পড়ে। এমন অনেক ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছেও। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, সুনামগঞ্জের শাল্লা, কুমিল্লা, খুলনা, দিনাজপুরসহ প্রায় মন্দির ও হিন্দুদের ওপর ভুয়া নিউজের জেরে অসাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে পড়েছিল। যেমন বাংলাদেশে তেমন ভারতেও ঘটেছে মুসলমানদের ওপর। একজন প্রকৃত গণমাধ্যমকর্মী কখনোই পরিপূর্ণ ঘটনা না জেনে বা না শুনে নিউজ করে না। কিন্তু বর্তমানে অনেক সাংবাদিক ভিউ কামানোর জন্য পরিপূর্ণ নিউজ না করে অর্ধেক নিউজের হেডলাইন দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যে, ব্যক্তি পরিপূর্ণ নির্দোষ, কিন্তু পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর সাংবাদিকদের ভুয়া নিউজে লোকটি হয়ে গেল স্মাগলার, খুনি বা ইয়াবা ব্যবসায়ী। অথচ সাংবাদিকের উচিত ছিল লোকটি সম্পর্কে পরিপূর্ণ তথ্য বের করা এবং তাকে ফাঁসানো হয়েছে কি না, সে সম্পর্কে তথ্য বের করা। এতে শুধু ব্যক্তির জীবনটি নষ্ট হয় তা নয়, একই সঙ্গে একটি পরিবারও ধ্বংস হয়ে যায়।

অফিস-আদালত যে তথ্য দেয় সেটার নিউজ নয়, নিউজ হবে সেটা যেটা তারা প্রকাশ করেনি, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তা বের করা হয়েছে। সত্য প্রকাশের জন্য গণমাধ্যমেরও কিছু লক্ষ্য থাকা উচিতÑ(ক) গণমাধ্যমের মূল লক্ষ্য হবে জনস্বার্থ। ব্যক্তিস্বার্থ, কোম্পানির স্বার্থ, ব্যবসায়িক স্বার্থ, গোষ্ঠীগত স্বার্থ ও রাজনৈতিক স্বার্থ থেকে দূরে থাকতে হবে; (খ) গণমাধ্যমে যাতে বৈচিত্র্যপূর্ণ চিন্তার প্রতিফলন হয়, সেজন্য বহুত্ব সৃজনশীলতা থাকতে হবে; (গ) এক ব্যক্তির অধীনে থাকা একাধিক গণমাধ্যম দূরে রাখতে হবে; (ঘ) রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলো (বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, বাসস) সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত রাখতে হবে; (ঙ) সম্পাদকরা হবেন বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ; (চ) মালিকানা মিডিয়াগুলো নিজস্ব আদর্শ ও মতবাদকে শুধু প্রচার করবে না, সেজন্য তাদের জবাবদিহি রাখতে হবে।

এভাবে গণমাধ্যম হতে পারে দালাল-চাটুকারমুক্ত এবং সমাজ ও দেশের জন্য একটি আদর্শ।
আধুনিক সময় মানুষ যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের খবরাখবর সঙ্গে সঙ্গেই জেনে যায়। প্রত্যেকের হাতে স্মার্টফোন থাকায় খবর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বিপদের সময় তারা যেমন ঐক্যবদ্ধ হয়ে সহযোগিতা করতে আসে, তেমনি মিথ্যা তথ্য ও গুজবেও তারা সংঘবদ্ধ হয়ে যে কোনো পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলতে পারে। তাই গণমাধ্যমকর্মীদের সব সময় সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। গণমাধ্যমেরও উচিত সত্য-মিথ্যা যাচাই-বাছাই করে সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করা। তবেই গণমাধ্যম হয়ে উঠবে দেশ ও জাতির মুখপত্র।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০