Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 1:28 am

সমুদ্রদূষণ বন্ধে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি

. . . মাছুম বিল্লাহ ভূঞা: বিশ্বের মানুষের জীবন ও জীবিকায় সমুদ্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। সব শোষণ যেমন ভালো নয়, তেমনি সব নিঃসরণও খারাপ নয়। সমুদ্রই হচ্ছে এর ব্যতিক্রম, কারণ বাস্তুসংস্থানের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে সমুদ্র। সমুদ্র আমাদের নানাভাবে উপকার করে চলে। ভূপৃষ্ঠের বায়ুমণ্ডলেও রয়েছে মহাসাগরের বিপুল ইতিবাচক প্রভাব। এই সাগর-মহাসাগরগুলো পৃথিবীর প্রায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। পৃথিবীতে মোট উৎপাদিত অক্সিজেনের ৭০ শতাংশই সমুদ্রের নিচে উদ্ভিদগুলো তৈরি করে। আমাদের অক্সিজেনের সবচেয়ে বড় জোগানদাতা হলো এসব সাগর-মহাসাগর।

সমুদ্র বিশাল এক জলরাশি। এর নামটি উচ্চারণ করলেই চোখে ভাসে নীল রঙের এক প্রকাণ্ড পানির উৎসের ছবি, যেখানে ক্রমাগত ঢেউ ছুটে আসছে। সেসব ঢেউয়ের মাথায় নাচছে সাদা ফেনার উচ্ছ্বাস। মানুষের শরীরের ফুসফুস ও কিডনি যেমন শরীরে ছাকনি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তেমনি সমুদ্রও ফুসফুস ও কিডনির মতো অক্সিজেন সরবরাহ এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণের মাধ্যমে প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রাণিকুলকে টিকিয়ে রেখেছে। মানুষের অক্সিজেন গ্রহণের স্বাভাবিক কার্যক্রম সম্ভব হতো না যদি পৃথিবীর ৭০ শতাংশজুড়ে সাগর-মহাসাগর না থাকত। তাই বিশ্বের সব সাগর ও মহাসাগরগুলোকে বলা হয় পৃথিবীর ফুসফুস ও কিডনি। তারপরও অবিবেচক মানুষ সমুদ্রের পরিবেশকে দিন দিন দূষিত করছে, যা ধীরে ধীরে পৃথিবীতে মানুষসহ প্রাণিজগৎকে অস্তিত্ব সংকটে ফেলছে। এর ফলে গোটা বিশ্বে সমুদ্র ও উপকূলবর্তী এলাকার উদ্ভিদ ও প্রাণিজগৎ আজ বিপন্নপ্রায়।

সমুদ্রের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা মানুষের মাঝে তুলে ধরতে কানাডার আন্তর্জাতিক মহাসাগর বিকাশ কেন্দ্র (আইসিওডি) এবং ওশান ইনস্টিটিউট অব কানাডা (ওআইসি) দ্বারা আর্থ সামিটে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরোতে পরিবেশ ও বিকাশ-বিষয়ক ইউএন সম্মেলন (ইউএনসিইডি) দ্বারা আন্তর্জাতিক মহাসাগর দিবস পালনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। ২০০৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দি ওশান প্রজেক্ট মহাসাগরীয় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক মহাসাগর দিবস পালনের বিষয়ে প্রচারণা চালিয়ে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরোতে সংঘটিত ধরিত্রী সম্মেলনে আন্তর্জাতিক মহাসাগর দিবস উদ্যাপনের এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরপর ২০০৮ সালের ৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৩তম অধিবেশনে গৃহীত ১১১ নম্বর প্রস্তাব অনুযায়ী ২০০৯ সাল থেকে দি ওশান প্রজেক্ট এবং ওয়ার্ল্ড ওশান নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রতি বছরের ৮ জুন আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটি পলিত হচ্ছে। মূলত ২০০৯ সাল থেকে বিশ্ববাসী ৮ জুনকে পালন করে আসছে বিশ্ব মহাসাগর দিবস হিসেবে। দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো সাগর-মহাসাগরের অবদান, গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা আর উপকারিতা ও ধ্বংসযজ্ঞ থেকে সচেতনতা সৃষ্টিতে স্বতন্ত্রভাবে বিশ্বের সবার সামনে তা তুলে ধরা। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে মহাসাগরের ভূমিকা, মহাসাগর রক্ষা এবং স্থিতিশীলভাবে সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবহারের জন্য অনুপ্রেরণামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জাতিসংঘ দিনটিকে পালন করে। বিশ্ব সমুদ্র দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য: Revitalization Collective Action for the Ocean.

পৃথিবীতে মানবজাতির টিকে থাকার অন্যতম চাবিকাঠি হলো সমুদ্র। এছাড়া আমাদের বেশিরভাগ খাদ্য ও ওষুধের উৎসও হলো সাগর ও মহাসাগর। কয়েকশ কোটির বেশি মানুষ সরাসরি সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। সমুদ্র থেকে মানুষ প্রতি বছর যে পরিমাণ সম্পদ আহরণ করে এবং এর ওপর ভিত্তি করে পণ্য উৎপাদন করে, তার অর্থনৈতিক মূল্য বছরে দাঁড়ায় প্রায় তিন লাখ কোটি ডলার। মহাসাগরগুলো আমিষের প্রধান উৎস। ৩০০ কোটির বেশি মানুষ তাদের প্রোটিনের প্রাথমিক উৎস হিসেবে সাগরের ওপর নির্ভর করে।

সমুদ্র জলবায়ু বিপর্যয় রোধে সর্বোচ্চ ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। পৃথিবীতে সূর্য থেকে আসা আলোকরশ্মি, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে নিঃসরণ করা কার্বন ডাই-অক্সাইড সমুদ্রই শোষণ করে নিচ্ছে। কিন্তু কার্বন ডাই-অক্সাইড দিন দিন বাড়তে থাকায় সমুদ্রের পানি অ্যাসিডিক হয়ে যাচ্ছে। মানুষের নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি জলবায়ু বিপর্যয়ের বৈরী থাবায় মহাসাগরগুলোর প্রতিবেশ ব্যবস্থা প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। দিনের পর দিন নানাভাবে তার ক্ষতি করেই চলছি, ফলে ধ্বংস হচ্ছে এর জীববৈচিত্র্য। এক পরিসংখ্যানের তথ্যমতে, মোট সাগর আর মহাসাগরের ৪০ শতাংশের বেশি ক্ষতির শিকার হয়ে গেছে। মানবসৃষ্ট দূষণ আর আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়ে চলছে এই মহান জলরাশিগুলো। বিজ্ঞানীরা বলেন, বিশ্বের যত প্লাস্টিক বর্জ্য সৃষ্টি হয়, তার প্রায় ১০ শতাংশ সমুদ্রে এসে পড়ে। জাতিসংঘের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সমুদ্রের প্রতি বর্গমাইলে প্রায় ৫০ হাজার প্লাস্টিকের বোতল ভাসতে দেখা যায়। এর পাশাপাশি তেল ও রাসায়নিকসহ বর্জ্য রয়েছে। 

পৃথিবীর ৩০০ কোটি মানুষ জীবন ও জীবিকার জন্য সরাসরি সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ জীব সমুদ্র ধারণ করে। বিশ্বের জলভাগের মাত্র পাঁচ শতাংশ মানুষ আবিষ্কার করতে পেরেছে। বাকিটা এখনও মানবসভ্যতার কাছে অজানা। বর্তমানে সারাবিশ্বের সমুদ্রে দুই লাখ ৩৬ হাজার ৮৭৮ ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী আছে। আগ্নেয়গিরির ৯০ শতাংশেরই উৎপত্তিস্থল সমুদ্র। অথচ পৃথিবীর চারপাশ বেষ্টিত সমুদ্রের মাত্র এক শতাংশ সংরক্ষণ করা হয়। 

জলাবায়ু বিপর্যয়, নানা রকম দূষণ ও সামুদ্রিক সম্পদের মাত্রাহীন ব্যবহারের ফলে আজ এই রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এর পরিস্থিতির ধারাবাহিকতার ফলে খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নয়নের গতিকে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এরই মধ্যে এর ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করতে হচ্ছে বিপুলসংখ্যক মানুষকে। আমরা এখন পর্যন্ত যা করেছি তা সমুদ্র রক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। তবে সাগর ও মহাসাগরগুলোকে বাঁচানোর সুযোগ দিন দিন কমে আসছে। পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশ জলের সমুদ্র রক্ষার্থে বর্জ্য ও দূষণ বন্ধ করার জন্য সতর্ক ঘণ্টা বাজানোর জন্য আমাদের এখনই কাজ করতে হবে। কারণ কোনো প্রযুক্তিই হুমকি থেকে সমুদ্রকে রক্ষা করতে পারবে না। তা করা সম্ভব না হলে, শিগগিরই মানুষকে মহা সংকটের মুখোমুখি হতে হবে। তাই টেকসই উন্নয়নের জন্য মহাসাগর, সমুদ্র এবং সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণ এবং টেকসইভাবে ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি।

আইনজীবী

masumbillahlaw06@gmail.com