নিজস্ব প্রতিবেদক : সমুদ্র সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে নানামুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ফলে কাজে লাগানো যাচ্ছে না সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে দক্ষতা ও সক্ষমতার অভাব, বিনিয়োগের অপ্রতুলতা, পর্যাপ্ত গবেষণা না থাকা, অধিক জনসংখ্যার চাপ, দ্রæত নগরায়ণ, অপরিকল্পিতভাবে সমুদ্র সম্পদ আহরণ, জলবায়ু পরিবর্তন, কোস্টাল ইকোসিস্টেম রক্ষা না হওয়া, দূষণ এবং আধুনিক প্রযুক্তির অভাব প্রভৃতি। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ সরকারি-বেসরকারি এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ সব পক্ষের সমন্বিত অংশগ্রহণ প্রয়োজন। কেননা টেকসই অর্থনীতির জন্য টেকসই সমুদ্র ব্যবস্থাপনা জরুরি।
পাশাপাশি শুধু মৎস্য আহরণই নয়, জ্বালানি, কৃষি, পণ্য পরিবহণ, মেরিন থেরাপিউটিক্স, অ্যাকুয়াকালচার ও পর্যটনসহ সমুদ্রকেন্দ্রিক অন্যান্য বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সেই সঙ্গে আলাদা একটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগ গঠনের তাগিদ দেয়া হয়েছে।
সুনীল অর্থনীতি নিয়ে দিনব্যাপী এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গতকাল বক্তারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তায় ‘ওশ্যান প্রোসপারিটি: ক্যাটালাইজিং বø– ইকোনোমি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ সম্মেলনের আয়োজন করে। বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পদের সঠিক ধারণা ও ব্যবহার নিশ্চিতে এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠনে তিনি বলেন, সমুদ্রে খনিজ ও প্রাণিজ সম্পদের পাশাপাশি উপক‚লীয় এলাকায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও বø–-কার্বনের অপার সুযোগ রয়েছে। বেসরকারি খাত ও উন্নয়ন সহযোগীদের সমন্বয়ে সরকারকে টেকসই এ খাত কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে হবে। সমুদ্র সম্পদ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগের বিকল্প নেই। স্পিকার আরও বলেন, টেকসই সমুদ্র সম্পদের সঠিক ব্যবহারে প্রয়োজনে আধুনিক টেকনোলজি, ধারণা ও অভিজ্ঞতা বিনিময় প্রয়োজন। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরি হলে সেটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জন্য বাণিজ্যের হাব তৈরি হবে। জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্র দূষণসহ নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের সমুদ্রের ইকো সিস্টেমের উন্নয়ন ও টেকসই ব্যবস্থাপনায় সহায়তা প্রয়োজন। যেমন বে টার্মিনাল প্রকল্পে বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাংক অর্থ সহায়তা দিচ্ছে, এরকম সমুদ্রকেন্দ্রিক বড় বড় অবকাঠামো ও গবেষণায় উন্নয়নসহযোগীদের এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি আরও বলেন, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা আমরা কাজে লাগাতে পারি। সমুদ্রের টেকসই ব্যবহার করতে হবে। অতিমাত্রায় মৎস্য আহরণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জলববায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ আছে। এসব মোকাবিলা করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সিদস্য (সচিব) ড. কাওসার আহমেদের সভাপতিত্বে সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুস সালাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মো. শহীদুজ্জামান সরকার, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট ইংমিং ইয়ং। বক্তব্য রাখেন এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর এডিমন গিন্টিং। সম্মেলনে উদ্বোধনী ও প্লেনারিসহ মোট আটটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এসব অধিবেশনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা বক্তব্য দেন।
উদ্বোধনী অধিবেশনে পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুস সালাম বলেন, বেসরকারি খাত ও গবেষকদের সমন্বয়ে সরকারের দেশের সমুদ্র সম্পদকে টেকসইভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে গেলে বøু ইকোনমি কাজে লাগানোর বিকল্প নেই। এটি অর্থনীতির লাইফলাইন হতে পারে। সমুদ্র নিয়ে ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। সমুদ্রকে কাজে লাগিয়ে আমরা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটন শিল্প গড়ে তুলতে কাজ করছি পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, মেরিন ট্রান্সপোটেশন আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণে ব্যাপক ভ‚মিকা রাখছে। সমুদ্র অর্থনীতি নিয়ে যেসব চ্যালেঞ্জ আছে, সেগুলো মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ভবিষ্যৎ প্রজšে§র জন্য টেকসই সমুদ্র নিশ্চিত করতে হবে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসাইন বলেন, ডেল্টা পরিকল্পনা ২১০০ বাস্তবায়নের মাধ্যমে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার পাশাপাশি সমুদ্রকে কাজে লাগাতে বন্দরসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করে চলেছে সরকার। এছাড়া মৎস্য আহরণ, খনিজ সম্পদের সম্ভাবনা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং পর্যটনসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চল। এখানে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। এটাকে কাজে লাগাতে কাজ চলছে। এডিবির ভাইস প্রেসিডেন্ট ইংমিং ইয়ং বলেন, বাংলাদেশ টেকসই অর্থনতির জন্য সুনীল অর্থনীতির বিকল্প নেই। এডিবি এ খাতে সহায়তা দেবে।
সম্মেলনের দিনব্যাপী বিভিন্ন অধিবেশনে অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান, অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াশিকা আয়শা খান, নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, সংসদ সদস্য মো. নাসের শাহরিয়ার জাহেদী প্রমুখ।
সমুদ্রের জ্বালানি সম্পদ বিষয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, সমুদ্রে মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে শেষ হয়েছে। আন্তর্জাতিক দরপত্র আহŸান করা হয়েছে। সেপ্টেম্বরে এটি শেষ হবে। মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠছে। গতবছর ৮০ হাজার টন ধারণক্ষমতার কয়লার জাহাজও ভিড়েছে। এখানে এলএনজি টার্মিনাল, কোল টার্মিনাল ও এলপিজি টার্মিনালের চিন্তা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। এছাড়া সেখানে হাইড্রোজেন পাওয়ারের সম্ভাবনা নিয়ে কাজ হবে। অনশোরে উইন্ড পাওয়ার ২৫ শতাংশ পর্যন্ত মিলছে কেন্দ্রের সক্ষমতা অনুযায়ী। আমার ধারণা অফশোরে তা আরও বেশি হবে। জলবিদ–্যতে ভালো সম্ভাবনা থাকতে পারে। এজন্য পরীক্ষামূলকভাবে প্রকল্প নেয়া যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, সামিটের এফএসআরইউ সচল হলে ১৫ জুলাইয়ের পর থেকে গ্যাস সংকট কমে আসবে।
অপর এক অধিবেশনে জাতীয় সংসদ সদস্য মো. নাসের শাহরিয়ার জাহেদী বলেন, ২০২৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশে জনসংখ্যা ২০ কোটি ছাড়াবে। কিন্তু মানুষ বাড়লেও তার বিপরীতে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। নদীগুলো আরও শুকিয়ে যাচ্ছে, সমুদ্র দূষিত হচ্ছে এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধির মতো সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় আমরা ভবিষ্যৎ প্রজšে§র জন্য কেমন দেশ রেখে যাব, তা নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। প্রাকৃতিক সম্পদকে টেকসই উপায়ে ব্যবহারের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করে সেখান থেকে সম্পদ আহরণ করতে হবে।
সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে সামগ্রিক কার্যক্রম সমন্বিতভাবে পরিচালনার স্বার্থে জাহেদী একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় বা বিভাগ প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেন। এছাড়া এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে তিনি দেশীয় ও বিদেশি উৎস থেকে অর্থ সংস্থানে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর জোর দেন।