মিজানুর রহমান শেলী: ভ্রমণে মন নেই এমন লোক মেলা দায়। নয়নাভিরাম আর হূদয়কাঁপানো সব দৃশ্যপট সবাইকে আনন্দিত, নয়তো আশ্চর্যান্বিত করে। তাই সুন্দরের লীলাখেলা যে ভূমিতে খেলে যায় অবলীলায়, সেখানেই লোকের আনাগোনা শুরু হয়। ওই ভূমির কদর বা অর্থনৈতিক মূল্য তখন লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে। চড়া দরেও মানুষ তার নন্দনে আনন্দিত হতে চায়। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন মহলের আর্থিক কর্মকাণ্ডের যেমন সুযোগ তৈরি হয়, তেমনি ব্যক্তিজনের কর্মসংস্থান ছড়িয়ে পড়ে। তখনই তার নাম হয় পর্যটনশিল্প। এ শিল্পের অবারিত সুযোগ সঞ্চারিত হয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে। তা অবশ্য ঢের বেশি আগে থেকেই। সম্পদ বা সৌন্দর্য হাত ভরে অথবা দু’চোখজুড়ে লুটে নেওয়ার নেশায় অথবা আশায় এ দেশে অনেকেই হুমড়ি খেয়েছে। সেসব ইতিহাসের কথা। তবে আজকের বাংলাদেশ তার সার্বভৌমত্বের দৃঢ়তায় এবং বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজারের খাতিরে পর্যটন এলাকাকে শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে নিতে চাইছে।
তাই ১৯৭১’র পরেই পর্যটন সংস্থা গঠিত হয়েছিল। পরে ১৯৭৩ সালে এটি বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন নামে নবগঠিত হলো। ওই সময় দেশের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (১৯৭৩-৭৮) আওতায় এ শিল্পেরও পরিকল্পনা গৃহীত হয়। তাতে দেশের প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত এলাকাগুলো পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলার জন্য সুযোগ-সুবিধা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়। পরের তিনটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেও একই ধারা অব্যাহত থাকে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি (বিপিসি ২০০৭)। এর পেছনে রাজনৈতিক কারণ ছিল মুখ্য (বিটিও ২০০৫)। আজ পর্যন্ত এসব সংকটের ভালো কোনো সমাধান আসেনি। বরং নতুন করে নানা সংকট দানা বেঁধেছে। এমনকি দেখা গেছে, বিপিসি যেখানে খুব বেশি সফলতা দেখাতে পারেনি, সেখানে বিভিন্ন প্রাইভেট লগ্নি হয়েছে সফলভাবে। প্রাইভেট এ লগ্নিকারীরা হোটেল বা ট্যুর ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ খাতে টিকে আছে। বর্তমানে বত্রিশের বেশি ট্যুর অপারেটর কোম্পানি দেশে কাজ করছে। এগুলোর কেউ কেউ কেবল দেশের মধ্যে, আবার কেউ বিদেশ ভ্রমণের কাজও করে থাকে (খন্দকার ও আহসান ২০১৫)। বিপিসির কাছ থেকে তাদের অধিকার আদায়ের তাগিদে এবং দেশে এ খাতের উন্নয়নে নিজেদের মধ্যে ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংস্থাও তারা গড়ে তুলেছে।
তবে এ খাতে যে বাংলাদেশ এখনও অনেক পিছিয়ে আছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তার চেয়ে পাশের দেশ ভারত পর্যটন খাতে সাফল্য অর্জন করেছে ঢের বেশি। তারা তাদের ঐতিহাসিক স্থাপনার মাধ্যমে এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি পর্যটন আকর্ষণ করতে পেরেছে। প্রতিবছরে তাদের দর্শনার্থী বৃদ্ধির হার ৪ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশের চিত্রটি খুবই হতাশাজনক। এখানে দর্শনার্থী আগমনের হার সব সময়ই অনিয়মিত।
২০০০ সালকে মধ্যবর্তী চিন্তা করে এর ওপরে ও নিচের চিত্র মূল্যায়ন করা যেতে পারে। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০০ সাল অবধি দর্শনার্থী বৃদ্ধির হার ছিল ৫.৮ শতাংশ। অন্যদিকে ২০০০ থেকে ২০১০ সার অবধি এ হার ৩.৯ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে দর্শনার্থী আগমনের সংখ্যা আগের চেয়ে বেশি। ২০০৫ ও ২০০৯ সাল একটু ব্যতিক্রম। এ সময় দর্শনার্থী বৃদ্ধির হার -২৩.৪ শতাংশ ও -৪২.৪ শতাংশ (বিপিসি)। এ চিত্র দেখলে সহজেই অনুমান করা যায় দেশের রাজনৈতিক অবস্থায় অস্থিরতা এ খাতে ধস নামার একটি কারণ। নির্বাচন এবং নির্বাচনপূর্ব অস্থিরতার কারণেও দেশে পর্যটকের সংখ্যা কমে গেছে অতীতে। সব কিছু মিলে বাংলাদেশে পর্যটন আগমনের হারকে একটি অস্থির লেখচিত্রে বিবেচনা করতে হয়। বাংলাদেশে সাইট ট্যুরিজম, বিজনেস ট্যুরিজম, অফিস ট্যুরিজম, এডুকেশন ট্যুরিজম, রিলিজিয়াস ট্যুরিজম, মেডিক্যাল ট্যুরিজম ও অন্যান্য ট্যুরিজম খাত রয়েছে। ২০০৯ সালের বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রতিবেদনে এসেছে, এ দেশে ৪১.৮ শতাংশ পর্যটক আসে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান ভ্রমণে। ৪১.৮ শতাংশ আসে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে। আর ৩.৪ শতাংশ ভ্রমণকারী অন্য সব উদ্দেশ্যে। তাই এটাকে সম্ভাবনাময়ী খাত হিসেবে না দেখলেই নই।
তাই অস্থির দশা কাটিয়ে ওঠার জন্য সঠিক কর্মপরিকল্পনা জরুরি। কেননা এ খাতের সফলতা অনেক বেশি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনতে সক্ষম। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুই উপায়ে এর অর্থনৈতিক প্রভাব বহুমুখী। আবাসন, রেস্তোরাঁ, যোগাযোগ, বিনোদন ও খুচরা ব্যবসার মাধ্যমে এ খাতে প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক প্রভাব তৈরি হয়। পরোক্ষ প্রভাবটি ব্যাপক বিস্তারধর্মী। জে. স্টাইনসের মতে, অর্থনীতির প্রায় সব খাতেই এটি প্রভাব রাখতে পারে। যেমন হোটেলকে কেন্দ্র করে খাদ্য, সেবা, বিনোদন, পোশাক, চারু-কারু বিভিন্ন শিল্পপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। তবে খন্দকার ও আহসান তাদের গবেষণায় আরেকটি প্রভাবের কথা বলেছেন। এটি হলো প্রণোদিত প্রভাব। এক্ষেত্রে দেখা যায় বাংলাদেশের যেসব এলাকায় পর্যটনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে সে এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন গতি আসায় তাদের গৃহস্থালি আয়, আর্থিক কাঠামো ও জীবন মানে পরিবর্তন এসেছে। সার্বিকভাবে বলতে হয় পর্যটনশিল্প বিক্রি, মুনাফা, কর্মসংস্থান, কর, রাজস্ব ও আয়ের খাতকে চাঙা করতে পারে। ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের ২০১৪ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ২০১৩ সাল অবধি ট্যুরিজম খাত জিডিপিতে ২.৫ শতাংশ অবদান রেখেছিল। এমনকি ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল অবধি এ হার প্রায় ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে বাড়তে থাকে। কিন্তু তার পর থেকে নিচে নামতে থাকে এবং তা ২০১৪ সালে হঠাৎ করেই নিচে নেমে ২.২ শতাংশে স্থির রয়েছে। আগের ধারা অব্যাহত থাকলে এবং ভালো পরিকল্পনা নিলে বাংলাদেশ ২০২৪ সালে জিডিপিতে অংশ নেওয়া বিশ্ব ট্যুরিজম খাতের তালিকায় ১৬৫-তে অবস্থান করতে পারত। ভারত তখন এ তালিকায় ১৩৫-এ অবস্থান করত।
সামষ্টিক অর্থনীতির দৃষ্টিতে বলা যায়, সবচেয়ে বড় এবং তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে। দেশে ৪.৫ শতাংশ মানুষ বেকারত্বের কষাঘাতে পিষ্ট। আরেকটি সংকট হলো কর্মীর যোগ্যতার চেয়ে নিম্নমানের কাজে নিয়োগ। এরা মোট কর্মজীবী মানুষের মধ্যে ২০.৮ শতাংশ। তাছাড়া দেশে প্রায় ৮৩.৪ শতাংশ মানুষ এমন সব কাজে যুক্ত যা দেশের জিডিপি বা জিএনপির হিসাবে আসে না। তাই বাংলাদেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পাশাপাশি এমন সব কর্মসংস্থান (ফরমাল সেক্টর) বৃদ্ধি করা দরকার, যা দেশের জিডিপি বা জিএনপির হিসাবকে ত্বরান্বিত করতে পারে। এ ক্ষেত্রে পর্যটনশিল্প একটি সম্ভাবনাময়ী খাত। এর সঙ্গে আবাসন, যোগাযোগ এবং বহুমুখী সম্পূরক ব্যবসায় কাঠামো গড়ে উঠতে পারে।
এখানে একটি বিষয় খুব চোখে পড়ার মতো যে, ২০১৪ সালে তিন মিলিয়ন মানুষ এ সেক্টরে কাজ করছিল। তখন দেশের পর্যটন খাতে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ ও পরিকল্পনা অনুযায়ী ডব্লিউটিসিসির তথ্যমতে, ২০২৪ সাল নাগাদ মোট চার মিলিয়ন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। অর্থাৎ ০.৩ শতাংশ কর্মসংস্থান বাড়বে। দুঃখজনক যে, দেশের বেকারত্ব সংকট ও তা মোচনের পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে এ চিত্রটিকে বর্তমানে একটি হতাশাজনক ব্যবস্থাপনা বলা চলে। বলতে হয়, এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে রাষ্ট্র কাঠামোর তেমন কোনো মাথাব্যথা দেখা যাচ্ছে না। তবে রাষ্ট্রকাঠামো অবশ্যই তার সামগ্রিকতার বিচারে এ পরিস্থিতির উন্নয়নে আশু কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। তাতে অন্তত ২০২৪ সালে গিয়ে ডব্লিউটিটিসির অনুসিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণ করা যাবে। একই সঙ্গে বেকারত্ব সংকট কমে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে।
পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে সবচেয়ে বড় নিয়ামক হলো বিনিয়োগ। বর্তমান বাংলাদেশে এ চিত্র একেবারেই নগণ্য। ২০১৩ সালের হিসাবে জিডিপির মাত্র ০.৩৯ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে পর্যটনশিল্পে। বিষয়টি আরও দুঃখজনক যে তার পর থেকে প্রায় ২০ ডিগ্রি কোণে বিনিয়োগের হার কমেই চলেছে।
বিপরীতক্রমে, এ খাতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের হারের দিকে লক্ষ করলে একটি অমিত সম্ভাবনা অবশ্যম্ভাবী বলে মনে হয়। কেননা বাংলাদেশ ২০০৯ সালে ৩.৯, ২০১০ সালে ৫.৫, ২০১১ সালে ৬.১, ২০১২ সালে ৭.৭ এবং ২০১৩ সালে ৮.৬ বিলিয়ন টাকা আয় করেছে।
তাই এ খাতে সরকার বেশি বিনিয়োগ লাভবান হতেই পারে। এক্ষেত্রে কিছু কৌশলী পদক্ষেপ নিতে হবে। মালয়েশিয়া একটা সময় থাইল্যান্ড কিংবা ইন্দোনেশিয়ার মতো প্রতিবেশী রাষ্ট্র অপেক্ষা এ খাতে পিছিয়ে ছিল। তারপর ১৯৯০-এর দশকে তারা কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেয় এবং সফলতা পেতে থাকে। ২০০৪ সালে তারা পর্যটন মন্ত্রণালয় নামে একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয়ের যাত্রা করে। মনে রাখা দরকার, এটি একটি শিল্প। আর যে কোনো শিল্পেরই ব্র্যান্ডিংটা জরুরি। সিঙ্গাপুর তার পর্যটনশিল্পকে ‘সিঙ্গাপুর গার্ল’ নামে ব্র্যান্ডিং করে। থাইল্যান্ডের ব্র্যান্ডিং হয়েছে ‘ল্যান্ড অব স্মাইলস’ নামে। মালয়েশিয়া ‘বিউটিফুল মালয়েশিয়া’ বলে আসছিল। পরে তা পরিবর্তন করে ‘অনলি মালয়েশিয়া’ তারপর ‘ফ্যাসসিন্যাটিং মালয়েশিয়া’ নামে ব্র্যান্ডিং করে। এরপর বর্তমানে এটি ‘মালয়েশিয়া, ট্রুলি এশিয়া’ নামে চলছে। আর আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিকে তাকালে দেখতে পাবো, তারা ‘ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া’ ব্যানারে তাদের মার্কেটিং করছে। আবার ভারতেও পর্যটনশিল্পের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় রয়েছে। ভারত তাদের পর্যটনশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ঐতিহাসিক স্থাপনা ও প্রত্নস্থলের রক্ষণাবেক্ষণে শুরুতেই উদ্যোগ নিয়েছে। তারা এমনভাবে এগুলোর ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন ও বাজারজাত করেছে যেন বহিরাগতদের যাতায়াত, আবাসন, বিনোদন সব কিছু মিলেই এক আকর্ষণ, যা তাদের চোখের সামনেই যেন ভাস্বর হয়ে রয়। তারা তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ভাণ্ডারকে এমনভাবে পশ্চিমাদের সামনে তুলে ধরেছে যেন লুকোনো কোনো সৌন্দর্য। এমনকি তারা জাতি হিসেবেও যেন আবৃত কোনো সৌন্দর্যের মাঝে পরস্ফুিটিত।
বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে আরেকটি বিষয় অবশ্য গুরুত্ববাহী তা হালো পর্যটন এলাকায় প্রতারকশ্রেণির দৌরাত্ম্য কমিয়ে আনা। একসময় ভারতে এ সংকট ছিল। ইদানীং ভারত সরকার সচেতনতামূলক অডিও, ভিডিও প্রোগ্রাম চালিয়ে প্রতারকদের প্রকোপ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। ভারত এ শিল্পর উন্নয়নে আশপাশের অবকাঠামো উন্নয়ন করেছে। কর্মসংস্থান তৈরিতে কৌশলী পদক্ষেপ নিয়েছে। বিভিন্ন ট্যুর এজেন্সিকে মিনিস্ট্রি অব ট্যুরিজমের আওতায় নিবন্ধনের ব্যবস্থা করেছে। এসব কারণে যেমন তাদের প্রচারণা বেড়েছে তেমন ব্যবস্থাপনায় এসেছে স্বচ্ছতা। ভারত বা মালয়েশিয়া এ খাতের প্রতি যখনই নজর বাড়িয়েছে তখনই এ খাতের উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রপক্ষ যদি এ সম্ভাবনার খাতটিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়, আলাদা মন্ত্রণালয়ের আওতায় নিয়ে এসে ভালো কৌশল অবলম্বন করতে পারে তাহলে সরকার ও জনগণ প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ ও সামগ্রিকভাবে লাভবান হবে।
লেখক: গবেষক
Add Comment