অনাথ শিশুর মতো যার জীবনখানি নিস্তরঙ্গে নিথর হতে পারতো নিযুত জীবনের নিঠুর নিয়তিপাশে তিনি জুগিয়েছেন হৃৎস্পন্দনের খোরাক। দেশের জন্য লড়েছেন। শূন্য জমিনে গড়েছেন ব্যবসায় কাঠামো। জীবনের সব অর্জন লিখে দিয়েছেন মানুষের নামে। তিনিই দেশের সবচেয়ে সফল ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’-এর জনক রণদা প্রসাদ সাহা। নারীশিক্ষা ও চিকিৎসায় নারী-পুরুষ কিংবা ধনী-গরিবের ভেদ ভেঙেছেন। তার জীবনেই রয়েছে সসীমকে ডিঙিয়ে অসীমে শক্তি সঞ্চারের কথামালা। এ জীবন ও কেতন যেন রোমাঞ্চিত হৃদয়েরই উদ্দীপ্ত প্রেরণা। পর্ব-৪২
মিজানুর রহমান শেলী: ‘গড়পড়তা চিন্তার মানুষের মতামতে তুমি নিজেকে দোদুল্যতায় ফেল না। স্বপ্ন দেখ তুমি, আর সেভাবে তুমি পাগল হয়ে গেছ। তুমি সফল হও, আর সেভাবে তুমি ভাগ্যবান। সম্পদ অর্জন কর, আর সেভাবে তুমি লোভী। এসবে পাত্তা দেবে না, সে তখন আদতে কিছুই ঠাহর করতে পারবে না তোমায়।’
আমেরিকান লগ্নিকারী এবং লগ্নি বিশেষজ্ঞ, লেখক রবার্ট জি. এলেনের এ বক্তব্য একজন প্রান্তিক বা অগঠিত মানুষের শূন্য অথবা প্রায় শূন্য থেকে শেখরে ওঠার মন্ত্র হতে পারে। তবে এ কথার মাঝেই একজন উদ্যোক্তার পুঁজি আহরণের তাগাদা রয়েছে। যিনি তার আর্থিক নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেন, এমনকি কামনা করেন অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, তিনি অবশ্য কমপক্ষে একটি বাড়তি আয়ের পথ খুঁজে বের করবেনই। এটা আদৌ কোনো বিলাসিতা নয়। বরং তা প্রয়োজনীয়তা। যে কেউ নিজে কিংবা তার পরিবারের আর্থ ও শ্রম চক্রের উত্থান-পতনের আশঙ্কা এড়িয়ে চলতে পারে না। এই সঙ্কট থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে তাই তাকে আয়ের বিচিত্র পথ খুঁজে ফিরতে হয়। এ কাজটি নিতান্ত সহজ নয়। কঠিন বটে! তাহলে একজন উদ্যোক্তা যদি হন প্রান্তিক মানুষ, যিনি ঋণের টাকায় বা যৌথ উদ্যোগে অন্যের লগ্নি খাটিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন, তার ঝুঁকি নিশ্চয় আরও অনেক বেশি। বিশেষত ব্যবসায় উত্থান-পতনের আশঙ্কা একটু বেশিই থাকে। তাই বিকল্প ব্যবসায় কাঠামো গড়ে তোলা যে কোনো উদ্যোক্তার জন্যই খুবই জরুরি। রণদা প্রসাদ সাহার এ ব্যবসা থেকেই সাংসারিক খরচ চালাতে হয়েছে। একই সঙ্গে তাকে জমিদার সতীশ বাবুর লগ্নি পরিশোধ করতে হয়েছে। তারপর লভ্যাংশ খাটিয়ে পুঁজির সংকট সমাধা করতে হয়েছে। এই বিশাল চাপ কেবল রণদার জন্য এক কয়লার ব্যবসার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব ছিল না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাড়তি আয় প্রধানত তিন ধরনের হতে পারে: এক. প্রত্যক্ষ, দুই.পরোক্ষ ও তিন. এই দুইয়ের মিশেল। নিজের সরাসরি সময়, শ্রম ও লগ্নি বিনিময়ে যে আয় আসবে তাকে প্রত্যক্ষ বাড়তি বা সম্পূরক আয় বলে। আর অন্য কারও শ্রম বা সময়ের বিনিময়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তির অনুপস্থিতিতেই যখন আয় আসবে তখন তাকে পরোক্ষ আয় বলে। যে কোনো রূপ-কাঠামোতে এ দুই প্রণালির মিশেল ঘটলে তাকে দুই প্রক্রিয়ার সমন্বিত প্রণালি বলা হয়। একটি আয়ের খাতে লোকসান হলে আরেকটি আয়ের খাতের লাভ দিয়ে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্য বিধান করা সম্ভব।
চরম সত্য কথা হলো, সম্পদ আহরণ ও তা ধরে রাখার নির্দিষ্ট কোনো কলা-কৌশল নেই। কোনো নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় এটা কেউ কাউকে শেখাতেও পারে না। আবার এটা কোনো জাদুমন্ত্রও নয়। আবার এটাকে খুব জটিল কিছুও ভাবা যায় না। এটা বরং একটি সৃজনী পদক্ষেপ। ধাপে ধাপে এটা সামনের দিকে এগিয়ে যায়। নিজের দৈনিক বা মাসিক আয়ের সামান্য লগ্নি করেই কাজটি সম্পন্ন করতে হয়। একসময় এটাকে এক সহজ পদক্ষেপ বলে মনে হয়।
এ ধরনের সম্পূরক ব্যবসার ক্ষেত্রে কয়েকটি পদক্ষেপ মেনে চলার পক্ষে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়ে থাকেন। যেমনÑ এক. প্রাথমিক আয়ের খাতটিকে নিশ্চিতকরণ, দুই. নিজ সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান, তিন. ক্ষেত্র নির্ধারণ, চার. সামাজিক বলয় প্রস্তুতকরণ, পাঁচ. নিজের সামাজিক বলয়ের চাহিদা অনুধাবন, ছয়. সমাধান নির্ধারণ, সাত. নির্বাহ পরিকল্পনা, আট. নমুনা অনুসরণ প্রভৃতি।
রণদা প্রসাদ সাহা তার সম্পূরক ব্যবসায় এসব উপায় বা কৌশল সচেতনভাবে মেনে চলেননি। তবে তার কিছু কিছু কর্মকৌশলের সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শগুলো মিলে যায়।
রণদা প্রসাদ সাহা প্রথমে তার কয়লার ব্যবসাটিকেই বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন। তার শ্রম, মেধা ও সময়Ñএই প্রাথমিক ব্যবসায় তিনি খরচ করেন। আর ফাঁকে ফাঁকে সময়, সুযোগ হলে টিন কিংবা লোহার ব্যবসায় সময় দিয়েছেন। বিশেষত, সম্পূরক ব্যবসা নিয়ে উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই। এ ব্যবসায় খুব বেশি ঝুঁকি নেওয়ার প্রয়োজনও নেই। এমনকি মূল কাজটি যদি কোনো ব্যবসায় উদ্যোগ হয়, তবে সেটার পেছনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব তো থাকবেই, অধিকন্তু তা যদি চাকরিও হয় তবুও সে কাজটিই বেশি গুরুত্ব পাওয়ার যোগ্য।
সম্পূরক ব্যবসায় নিজের সক্ষমতাকে পুরো বিচার করা উচিত। কেননা এখানে বেশি ঝুঁকি নেওয়ার কোনো সুযোগই নেই। যেহেতু এখানে কম সময় ও শ্রমের বিনিময়ে লাভ করতে হবে। সেহেতু সে কাজটি হতে হবে নিজের সক্ষমতার বিচারে সহজসাধ্য। এজন্য নিজের জ্ঞান, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা বিশেষভাবে মর্যাদাপূর্ণ। নিজের এ তিনটি বিষয়ের প্রতি যদি আত্মবিশ্বাস থাকে, এমনকি অন্যরা এ যোগ্যতাগুলোকে যথাযথা মূল্য দিতে প্রস্তুত থাকবে বলে মনে হয়, তবেই সেই সম্পূরক খাতে নামা যেতে পারে। এক্ষেত্রে নিজের সামাজিক মর্যাদা বা শ্রেণিও অনেক গুরুত্বাবহ হয়ে ওঠে। রণদা প্রসাদ সাহা যখন কয়লার ব্যবসা করেছেন, তখন আসলে তিনি এমন কোনো ব্যবসায় নামেননি যা তার সাধ্য, জ্ঞান আর অভিজ্ঞতাকে অতিক্রম করে। এমনকি একজন কয়লার ফেরি বা মধ্যস্বত্বব্যবসায়ীর জন্য ভাঙারি বা পুরোনো লোহা ও টিনের ব্যবসা অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিশেষজ্ঞরা আবার এই সম্পূরক কাজটিকে ব্যক্তির বিশেষ যোগ্যতা বা সৃজনী ক্ষমতার সঙ্গে সংসৃষ্ট হওয়ার জন্য গুরুত্বারোপ করেছেন। ব্যক্তি যদি নিজেকে অন্যদের চেয়ে কোনো বিশেষ কাজে অনন্য সাধারণ হতে পারেন, সেই কাজে যদি তিনি সৃজনী ক্ষমতার অধিকারী হন তবে তিনি স্বাভাবিকভাবেই সম্পূরক কাজ হিসেবে সেটা গ্রহণ করবেন।
রণদা প্রসাদ সাহা যখন ফেরি করে বাড়ি বাড়ি কয়লা বিক্রি করেছেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই একটি সামাজিক পরিচিত তিনি পেয়েছেন। এটা ছিল তার একটি সামাজিক বলয়। এর পাশাপাশি যে মাজার থেকে তিনি কয়লা খরিদ করেছেন সেটাও তার বলয়ের অংশ। এ বলয়কেই তিনি যেমন বাড়াতে চেয়েছেন, তেমনি এই বলয়ের ভেতর থেকে তিনি ব্যবসায় সুবিধাও বের করে নিতে চেয়েছেন। এ কারণেই তিনি বাড়ি বাড়ি কয়লা বিক্রির পাশাপাশি মিল-কারখানা অবধি তার সামাজিক-ব্যবসায়িক বলয় তৈরির প্রচেষ্টা চালালেন। সফলও হলেন। এ বলয়ের পুরোটাই ছিল পুরোনো টিন বা লোহার বাজার বা বিক্রির ক্ষেত্র।
আজকের যুগে ব্যবসায় কাঠামোর আধুনিকীকরণের ফলে নতুন কিছু সংযোজন হয়েছে। একজন আমেরিকান আত্মনির্মিত সফল ব্যবসায়ী ও ব্যবসায় বিশেষজ্ঞ, ‘লুজার গোজ ফার্স আন্ড রক অন’সহ আরও অনেক গ্রন্থেও লেখক ড্যান কেনেডি ব্যবসায় সামাজিক বলয়ের তৈরির ব্যাপারে আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হলো আপনার ই-মেইল তালিকায় যে ই-মেইল ঠিকানা আছে। এটাকেই গুরুত্ব দিন।’ ড্যান কেনেডি এখানে আসলে সামাজিক বলয়ের কথা বলেছেন। ‘দি মিরাকেল মর্নিং: দ্য নট-সো-অবভিয়াস সিক্রেট’ গ্রন্থের লেখক হাল এলরড বলেন, আমার ই-মেইল ঠিকানাগুলোকে আমি কেবল কিছু নামের তালিকা মনে করি না। বরং আমি এটাকে একটি সামাজিক বলয় মনে করি। আর এটাই আমার ব্যবসায় উদ্যোগ গ্রহণের সবচেয়ে বড় মাধ্যম।
রণদা বঙ্গশ্রী কটন মিলে কয়লা দেওয়া শুরু করার পরে তিনি নিজ পরিচিতি বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন মিল-কারখানার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। সফলও হয়েছেন। প্রতিটি বাড়ির গৃহস্থালি চাহিদা থেকে শুরু করে বিভিন্ন মিল-কারখানা ও স্থানীয় বাজারের চাহিদা তিনি নির্ণয় করেছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চাহিদা নির্ণয় হয়ে গেলেই উদ্যোক্তার হাতে চলে আসে এক সোনালি সুযোগ। তখন তিনি সেই অনুযায়ী নিজের ব্যবসায়িক লাভ-লোকসানের হিসাব কষে চাহিদা অনুযায়ী যথাযথ সমাধান দিতে পারলেই সফলতা হাতের মুঠোই চলে আসে। এক্ষেত্রে কীভাবে একজন উদ্যোক্তা তার পণ্য বা সেবা উপস্থাপন করবেন সেটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পণ্যের সুবিধা, গুণাগুণ জানানো বোঝানো এবং আকৃষ্ট করার জন্য বিশেষ পরিকল্পনাও থাকা উচিত বলে মনে করা হয় বিপণন শাস্ত্রে।
ব্যবসায় বাণিজ্যের কৌশল কেবল পাঠ্যবই থেকে শেখানো নয়। অনুসরণীয় ব্যক্তিজন বা সেই পেশায় যিনি অভিজ্ঞ তার থেকে বুদ্ধি পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। রণদা প্রসাদ সাহা তার ব্যবসায় উদ্যোগের এ প্রারম্ভিক পর্বে জমিদার সতীশ বাবুর কাছ থেকে বুদ্ধি-পরামর্শ নিতেন।
কার্যত, রণদা প্রসাদ সাহাকে তার ব্যবসায় পরিকাঠামো এবং পরিধি বাড়াতে পুঁজি সংকট পাড়ি দিতে হয়েছে। পুঁজি সংকট কাটিয়ে উঠতে তিনি বিভিন্ন রকম সম্পূরক ব্যবসা করেন। এগুলো ছোট-বড়, দীর্ঘমেয়াদি বা ক্ষুদ্রমেয়াদি। এসব সম্পূরক ব্যবসার মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যবসা ছিল লোহা ও টিনের ব্যবসা। তিনি প্রথম দিকে নিজেই ব্যবসা নির্বাহ করেছেন। তাই প্রথম পর্যায়ের সম্পূরক ব্যবসাগুলোকে প্রত্যক্ষ সম্পূরক ব্যবসা বলতে হয়। পরে একার পক্ষে সম্ভব না হলে তার ভাইকে দিয়ে নির্বাহ করালেন। তখন থেকে তার এই সম্পূরক ব্যবসাটি হয়ে গেল পরোক্ষ সম্পূরক ব্যবসা। এর মাঝামাঝি তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পূরক ব্যবসাকে সমন্বিত রূপেও তিনি নির্বাহ করেছেন।
কার্যত, এই সম্পূরক ব্যবসা তার ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল।
গবেষক, শেয়ার বিজ
mshelleyjuÑgmail.com