সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: স্বাধীনতার আগে ২১টি ট্যানারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছিল। এরপর ১৯৯১ সালে টিকে গ্রুপ রিফ লেদার স্থাপন করে। তারপর ৩৩ বছর কেটে গেলেও কেউ নতুন করে ট্যানারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেনি। উল্টো ৩৩ বছরের ২১টি ট্যানারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। অথচ চট্টগ্রামে ইটিপিসহ ট্যানারি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের রয়েছে প্রচুর জমি, কাঁচামাল, অবকাঠামোগত সুবিধা ও অগুণতি বিনিয়োগকারী। তবুও সম্ভাবনার পর নতুন কোনো ট্যানারি শিল্প গড়ে ওঠেনি।
জানা যায়, বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমিতি কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সাড়ে চার লাখ পিস। এবার সেই লক্ষ্যমাত্রা ছুঁয়েছে। তবে সংগৃহীত সাড়ে চার লাখ চামড়ার মাত্র এক লাখ কেনে চট্টগ্রামে চালু থাকা প্রতিষ্ঠানটি। বাকি চামড়া ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। এ আড়তগুলোয় চট্টগ্রামে জবাই করা কোরবানির গরু-ছাগলের ৮০ শতাংশ কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ করা হয়। এবার সরকার প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম ৫০ থেকে ৫৫ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও আড়তে চামড়া বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকা বর্গফুট দামে। এর চেয়ে বেশি দামে চামড়া কিনতে রাজি নন আড়তদাররা। আড়তে উপযুক্ত দাম না থাকায় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মৌসুমি চামড়া ক্রেতারাও কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে চামড়া কিনেছেন।
সূত্র জানিয়েছে, পাকিস্তানের বহু ব্যবসায়ী শিল্পপতি চট্টগ্রামে ট্যানারি শিল্প গড়ে তুলেছিলেন। মূলত সস্তা শ্রম, প্রচুর কাঁচামাল এবং বন্দর সুবিধাসহ নানা সুবিধা কাজে লাগিয়ে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রপ্তানি করতেন। তখন পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের হাতে ট্যানারি শিল্পের প্রায় পুরো নিয়ন্ত্রণই ছিল। ট্যানারি শিল্পের স্বর্ণযুগে চট্টগ্রামে বাংলাদেশি মালিকানাধীন মন্টি ট্যানারি নামের একটি মাত্র ট্যানারি ছিল। বাকি সব ট্যানারি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের মালিকানাধীন। স্বাধীনতার পর কারখানাগুলো সরকারের হাতে চলে যায়। সরকারি খাতে কিছুদিন চালানোর পর দেশের ব্যবসায়ীরা এগুলো কিনে নেন। পুরোনো ট্যানারিগুলোর পাশাপাশি বেশ কিছু নতুন ট্যানারিও ওই সময় গড়ে ওঠে। হিলটন লেদার নামের ট্যানারি ছিল ওই সময়কার দেশের প্রথম অত্যাধুনিক ট্যানারি। এরই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামে ওরিয়েন্ট ট্যানারি, মেঘনা ট্যানারি, জামান রহমান ট্যানারি, জুবিলি ট্যানারি, সিকো লেদার, চিটাগং লেদার, কর্ণফুলী লেদার, মদিনা ট্যানারি, মেট্রোপলিটন লেদার, রিফ লেদারসহ ২২টি ট্যানারি গড়ে ওঠে। বেশ জমজমাট ব্যবসা চলে ট্যানারি শিল্পের। চট্টগ্রাম থেকে কোটি কোটি টাকার চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়। কিন্তু একপর্যায়ে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়ে। একে একে বন্ধ হতে থাকে ট্যানারি। শুরুতে মেট্রোপলিটন লেদার চট্টগ্রাম থেকে ব্যবসা গুটিয়ে ঢাকায় চলে যায়। বাকিগুলোর মধ্যে শুধু রিফ লেদার চট্টগ্রামে থাকলেও বাকিগুলো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে অনেকগুলোর অস্তিত্বই বিলীন হয়ে গেছে।
ব্যবসায়ীরা বলেন, গ্রিন কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক চাপ, পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের বিধিবিধান বাস্তবায়ন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবসহ নানা সংকটে চট্টগ্রামের ২২টি ট্যানারির ২১টিই বন্ধ হয়ে গেছে। চট্টগ্রামে কোরবানিসহ বছরজুড়ে চামড়ার যে জোগান তাতে অন্তত ৩০টি ট্যানারি চলতে পারে। অথচ বর্তমানে কেবল একটি ট্যানারি চালু রয়েছে।
অপরদিকে আতুরা ডিপো এলাকার চামড়া ব্যবসায়ীরা বলেন, ‘শুধু কোরবানিতে চট্টগ্রামে প্রায় পাঁচ লাখের মতো গরু-মহিষ ও ছাগলের চামড়া পাওয়া যায়। এর বাইরে বছরজুড়ে চট্টগ্রামে পাওয়া চামড়ার সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। এসব চামড়া দিয়ে চট্টগ্রামে অনায়াসে ৪০টি কারখানা চলতে পারবে। অথচ চট্টগ্রামে একটি কারখানা চলছে; যা পুরো বছরে লাখ খানেক চামড়া ব্যবহার করতে পারে।’
এ বিষয়ে বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমিতির সভাপতি মুসলিম উদ্দীন বলেন, ‘এখন চামড়ার দাম কম পাওয়ায় অনেকেই চামড়া বিক্রি করা কমিয়ে দিয়েছেন। বেশির ভাগই দান করে দেন। এর একটা প্রভাব ব্যবসার ওপরে পড়েছে। একসময় আতুড়ার ডিপোতে ৩৫০ জন আড়তদার থাকলেও এখন আছেন ১২০ জন। তবে আমরা টার্গেট অনুসারে চামড়া সংগ্রহ করেছি।’
এ বিষয়ে রিফ লেদারের পরিচালক মুখলেছুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে ট্যানারিশিল্পের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু নানা প্রতিকূলতায় চট্টগ্রামে ২১টি ট্যানারি বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু আমাদের প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। মূলত তখন বিদেশিদের চাহিদা অনুসারে পণ্য দিতে পারেনি। এছাড়া কমপ্লায়েন্সের একটি বিষয় ছিল এবং আছে। অনেক প্রতিষ্ঠনের কমপ্লায়েন্স ছিল না। তখন সরকারের তেমন সাপোর্ট ছিল না। সবমিলিয়ে এমন পরিস্থিতি হয়েছে। এখন আমাদের জনসংখ্যা বেড়েছে। সঙ্গে আমাদের কোরবানিও বেড়েছে। বিশাল স্থানীয় বাজার রয়েছে। ফলে এখন সম্ভাবনা আরও বেশি; তবে সবকিছু মিলে ট্যানারি শিল্পে বিনিয়োগ বন্ধ রয়েছে বহুদিন ধরে, তা বেদনাদায়ক।