Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 5:07 am

সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নামে ৫৩০ কোটি টাকা অপচয়!

ইসমাইল আলী: ৫০ কোটি টাকা বা তার বেশি ব্যয়ের উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণে সম্ভাব্যতা যাচাই বাধ্যতামূলক। সরকারের এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা অনুসরণ করতে গিয়ে বর্তমানে বেশিরভাগ প্রকল্প গ্রহণের আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। তবে এর অপব্যবহারও হচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় বা কম গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রকল্প গ্রহণের জন্য করা হচ্ছে সম্ভাব্যতা যাচাই। পরে বাতিল করে দেয়া হচ্ছে প্রকল্পটি আর অপচয় হচ্ছে সরকারি অর্থ।

এমন চিত্রই দেখা গেছে অবকাঠামো খাতে তিন মেগা প্রকল্প ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে, হাইস্পিড ট্রেন লাইন ও ঢাকা শহরে সাবওয়ে নির্মাণের ক্ষেত্রে। প্রকল্পটি তিনটিতে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ৫৩০ কোটি টাকা। এরপর নানা অজুহাতে প্রকল্পগুলো বাতিল করা হয়েছে বা হওয়ার পথে আছে। ফলে পুরো টাকাই গচ্চা গেছে।

সূত্রমতে, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে যানবাহনের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় মূল মহাসড়কের পাশে ছয় লেনের পৃথক এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয় এক দশক আগে। এজন্য সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে ব্যয় করা হয়েছে ৯৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরে হাইস্পিড ট্রেন চালু করার উদ্যোগও নেয়া হয়। এজন্য সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশা প্রণয়নে পৃথক প্রকল্প নেয়া হয়। এ প্রকল্পে ব্যয় হয় ১১০ কোটি টাকার বেশি। প্রকল্প দুটির অগ্রগতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরা হলে তিনি এক্সপ্রেসওয়ে ও হাইস্পিড রেলপথের সেতুগুলো সমন্বিতভাবে নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছিলেন।

এরপর হঠাৎ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিল করে সরকার। এর পরিবর্তে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে শুধু হাইস্পিড ট্রেন চালুর পরিকল্পনা নেয়া হয়। মূলত রেলওয়ের চাপে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এক্ষেত্রে রেলের পক্ষ থেকে যুক্তি দেয়া হয়, এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হলে হাইস্পিড ট্রেনে কাক্সিক্ষত যাত্রী পাওয়া যাবে না। আর হাইস্পিড ট্রেন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন/বিনিয়োগ দরকার ছিল প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। তবে তা না পাওয়ায় এ প্রকল্পটিও ঝুলে গেছে। এখন বলা হচ্ছে, পরবর্তীকালে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।

এদিকে ঢাকায় সাবওয়ে নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প নেয়া হয় ২০১৮ সালে। প্রাথমিকভাবে ৯০ কিলোমিটার পাতাল রেল নির্মাণের কথা থাকলেও পরে তা সম্প্রসারণ করা হয়। এতে ২৫৮ কিলোমিটার সাবওয়ে রুট চিহ্নিত করা হয়। এজন্য ব্যয় করা হচ্ছে ৩২১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।

সম্প্রতি সাবওয়ে-সংক্রান্ত ড্রাফট ফাইনাল রিপোর্ট জমা দেয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এতে পাতাল রেলের রুট চিহ্নিত করা হয়েছে ১১টি। আর পুরো পাতাল রেল নেটওয়ার্কে স্টেশনের সংখ্যা হবে ২১৫টি। এই ১১টি সাবওয়ে নির্মাণে সম্ভাব্য বিনিয়োগ ধরা হয়েছে আট লাখ ৭১ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা।

ড্রাফট ফাইনাল রিপোর্টে ১১টি সাবওয়ের মধ্যে তিনটি রুটকে অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পরে সেগুলোয় বিনিয়োগ করার জন্য জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তবে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। ফলে অনেকটাই ঝুঁকির মুখে পড়েছে সাবওয়ে বাস্তবায়ন।

এতে বাধ্য হয়ে অন্তত একটি সাবওয়ে নির্মাণে দক্ষিণ কোরিয়ার ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিসিএফ) পাওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে সেতু কর্তৃপক্ষ। এজন্য সম্প্রতি দেশটিকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এতে টঙ্গী থেকে ঝিলমিল পর্যন্ত সাবওয়ে নির্মাণে বিনিয়োগ প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এ রুটের দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছে ২৯ দশমিক ৩৮ কিলোমিটার আর স্টেশন হবে ২৭টি। কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল থেকে তেঘরিয়া বাজার, মুসলিম নগর, সদরঘাট, গুলিস্তান, কাকরাইল, হাতিরঝিল, বিজি প্রেস, ভাসানটেক, কালশী ও উত্তরা সেক্টর ১৭ হয়ে টঙ্গী জংশন পর্যন্ত যাবে এ পাতাল রেলপথটি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামছুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নামে এভাবে অর্থের অপচয় অবশ্যই দুঃখজনক। কারণ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোন ধরনের প্রকল্প গ্রহণযোগ্য বা ভায়াবল হবে, তা মোটামুটি ধারণা করা যায়। এক লাখ কোটি টাকায় বুলেট ট্রেন বা পৌনে ৯ লাখ কোটি টাকায় সাবওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ তিন প্রকল্পের মধ্যে শুধু এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ গ্রহণযোগ্য ছিল।

তিনি বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক রুট। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এ রুটে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা জরুরি। কারণ সারাবিশ্বেই এক্সপ্রেসওয়ের ধারণা এসেছে ব্যবসা-বাণিজ্যকে ফ্যাসিলিটেট করার জন্য। গভীর সমুদ্রবন্দর হচ্ছে, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে যাচ্ছে সরকার। তাই এখনই সময় দেশের সড়ক অবকাঠামোকে প্রস্তুত করে নেয়ার।

তিনি আরও বলেন, হাইস্পিড ট্রেনের জন্য একটি দেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও আয়তন গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের আয়তন এত ছোট যে, চাইলেও এখানে হাইস্পিড ট্রেন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বরং ট্রেন ব্যবস্থা উৎসব তথা ঈদে, পর্যটনকে আকর্ষণ করতে বা একটি নির্দিষ্ট সেগমেন্টকে সুবিধা দিতে পারবে। তবে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হাইস্পিড ট্রেন খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে না।

অধ্যাপক শামছুল হক বলেন, ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় ছয়টি মেট্রোরেল ও বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) রুট চিহ্নিত করা হয়েছিল। পরে ২০১৫ সালে সংশোধিত পরিকল্পনায় এ সংখ্যা সাতটি করা হয়। সে সময় ঢাকায় যানবাহন ও জনগণের যাতায়াতের বিষয়ে বিশদ সমীক্ষা করে জাইকা। তাই সে পরিকল্পনার বাইরে হঠাৎ করে সাবওয়ে নির্মাণ পরিকল্পনা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। আর সাবওয়ে নির্মাণ বিশ্বব্যাপী ব্যয়বহুল প্রকল্প। তাই এ ধরনের উদ্যোগ বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়। ফলে এ ধরনের প্রকল্প সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের আগে অনেক বিষয় যাচাই-বাছাই করে দেখা উচিত।