ইসমাইল আলী: ঢাকাকে ঘিরে ১১টি পাতাল রেল (সাবওয়ে) নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। সব মিলিয়ে তিন ধাপে ২৫৮ কিলোমিটার সাবওয়ে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হবে। এজন্য সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন হয়েছে। আর সাবওয়ে নির্মাণে বিনিয়োগ দরকার হবে আট লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে সাবওয়ে নির্মাণে বিনিয়োগে আগ্রহী নয় কোনো দাতা সংস্থা।
বিভিন্ন দাতা সংস্থার সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করলেও ইতিবাচক সাড়া পায়নি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগী সংস্থা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)। আর দাতা সংস্থার বিনিয়োগ ছাড়া এত বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়নও সম্ভব নয়। ফলে শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়তে যাচ্ছে সাবওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ। এতে গচ্চা যেতে বসেছে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ৩২২ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, ঢাকায় সাবওয়ে নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প নেয়া হয় ২০১৮ সালে। প্রাথমিকভাবে ৯০ কিলোমিটার পাতাল রেল নির্মাণের কথা থাকলেও পরবর্তীতে তা সম্প্রসারণ করা হয়। এতে ২৫৮ কিলোমিটার সাবওয়ে রুট চিহ্নিত করা হয়। সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত ড্রাফট ফাইনাল রিপোর্ট জমা দেয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এতে সব মিলিয়ে পাতাল রেলের রুট চিহ্নিত করা হয়েছে ১১টি। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ২০৩০ সালের মধ্যে ১২৭ কিলোমিটার, দ্বিতীয় ধাপে ২০৫০ সালের মধ্যে আরও ৬০ কিলোমিটার এবং শেষ ধাপে ২০৭০ সালের মধ্যে ৭১ কিলোমিটার পাতাল রেল নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে।
সাবওয়ের রুটগুলোর মধ্যে গাবতলী থেকে বেলাবো পর্যন্ত রুট ‘বি’, কেরানীগঞ্জ থেকে পূর্ব নন্দীপাড়া পর্যন্ত রুট ‘ডি’, গাবতলী থেকে বসুন্ধরা রিভারভিউ পর্যন্ত রুট ‘জি’, হাজারীবাগ থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত রুট ‘জে’, ঝিলমিল থেকে টঙ্গী জংশন পর্যন্ত রুট ‘ও’, শাহ কবির মাজার রোড থেকে সদরঘাট পর্যন্ত রুট ‘পি’, কেরানীগঞ্জ থেকে সোনাপুর পর্যন্ত রুট ‘এস’, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত রুট ‘টি’, তেঘরিয়া বাজার থেকে বন্দর পর্যন্ত রুট ‘ইউ’, টঙ্গী জংশন থেকে কোনাবাড়ি পর্যন্ত রুট ‘ভি’ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গাবতলী পর্যন্ত রুট ‘ডব্লিউ’ চিহ্নিত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে পুরো পাতাল রেল নেটওয়ার্কে স্টেশনের সংখ্যা হবে ২১৫টি। আর ১১টি সাবওয়ে বাস্তবায়নে
সম্ভাব্য বিনিয়োগ ধরা হয়েছে আট লাখ ৭১ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা।
ড্রাফট ফাইনাল রিপোর্টে তিনটি রুটকে অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এগুলো হল ‘বি’, ‘ও’ এবং ‘এস’ রুট। এগুলোয় বিনিয়োগের জন্য জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে যোগাযোগ করে বিবিএ। তবে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। ফলে অনেকটাই ঝুঁকির মুখে পড়েছে সাবওয়ে বাস্তবায়ন।
জানতে চাইলে বিবিএ’র ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধের পর থেকেই বিবিএ’র সঙ্গে দাতা সংস্থাদের সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। মাঝে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য জাইকাকে প্রস্তাব দেয়া হলে তারা সেটাও ফিরিয়ে দেয়। এবার সাবওয়ে নির্মাণের জন্য প্রস্তাব করা হলে জাইকা ও এডিবির থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। যদিও মেট্রোরেল নির্মাণে জাইকা বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করছে।
তিনি আরও বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ ছাড়া সাবওয়ে নির্মাণ সম্ভব না। এতে সাবওয়ে বাস্তবায়ন ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। আর যদি বিদেশি বিনিয়োগ না পাওয়া যায় তাহলে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ব্যয় করা ৩২২ কোটি টাকাই গচ্চা যাবে।
সূত্রমতে, প্রথম ধাপে বাস্তবায়নের জন্য চিহ্নিত সাবওয়ে তিনটি নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ৫০ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা। এছাড়া দ্বিতীয় ধাপের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে দুই লাখ ৯২ হাজার ১৯২ কোটি এবং শেষ ধাপের জন্য দুই লাখ ২৯ হাজার ৩১ কোটি টাকা। দাতা সংস্থার বিনিয়োগ ছাড়া এগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই সাবওয়ে নির্মাণে দক্ষিণ কোরিয়ার ইকোনোমিক ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিসিএফ) পাওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে সেতু কর্তৃপক্ষ। এজন্য সম্প্রতি দেশটিকে চিঠি দেয়া হচ্ছে।
প্রাথমিকভাবে ‘ও’ রুটে অর্থাৎ টঙ্গী থেকে ঝিলমিল পর্যন্ত সাবওয়ে নির্মাণে বিনিয়োগ প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এ রুটের দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছে ২৯ দশমিক ৩৮ কিলোমিটার আর স্টেশন হবে ২৭টি। কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল থেকে তেঘরিয়া বাজার, মুসলিম নগর, সদরঘাট, গুলিস্তান, কাকরাইল, হাতিরঝিল, বিজি প্রেস, ভাসানটেক, কালশী, উত্তরা সেক্টর ১৭ হয়ে টঙ্গী জংশন পর্যন্ত যাবে এ পাতাল রেলপথটি।
সাবওয়ের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্পের পরিচালক কাজী মো. ফেরদাউস এ প্রসঙ্গে বলেন, ঝিলমিল-টঙ্গী রুটে সাবওয়ে নির্মাণে ইডিসিএফের ঋণ পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এখনো বিষয়টি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তাই এখনই এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না।
উল্লেখ্য, ঢাকায় পাতাল রেল নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে গৃহীত ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি অ্যান্ড প্রিলিমিনারি ডিজাইন ফর কনস্ট্রাকশন অব ঢাকা সাবওয়ে’ শীর্ষক প্রকল্পটি আগামী জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এজন্য ব্যয় হচ্ছে ৩২১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। পাতাল রেলের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে স্পেনের কোম্পানি টিপসার নেতৃত্বে যৌথভাবে জাপানের প্যাডকো, বাংলাদেশের বিসিএল অ্যাসোসিয়েটস, কেএসসি ও বেটস কাজ করেছে।