এম এম জামান: ঢাকা এখন বিশ্বের অন্যতম আলোচিত শহর। বিশ্বে বসবাসের অযোগ্য চারটি শহরের একটি। এ শহরে প্রায় দেড় কোটি মানুষ বাস করে। রাষ্ট্র ও সরকারের প্রথম সারির লোকজন থেকে শুরু করে ভিক্ষুকও এ শহরের অধিবাসী। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেক আলোচনা হলেও ঢাকাবাসীর বিকার নেই। তারা এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কাদা আর নর্দমার পানিতে একাকার দুর্গন্ধময় এক শহর ঢাকা। ময়লা-আবর্জনার কারণে রাস্তায় হাঁটা যায় না। ভিড়ের কারণে বাসে ওঠা যায় না। যানজটে নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো যায় না। এ শহরে নেই উন্নত শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা। বায়ু ও পানিদূষণের কারণে ৮০ শতাংশ মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত। এ শহরে একজন নন, দুজন মেয়র থাকলেও কেউ সুপেয় জলের নিশ্চয়তা দিতে পারেননি। ভবিষ্যতে পারবেন কি না, সে প্রতিশ্রুতিও দিতে পারছেন না। এ শহরে এক ঘণ্টা বৃষ্টি হলে অনেক রাস্তায় শিশুরা সাঁতার কাটে। তারপরও এর প্রতি কিন্তু মানুষের মোহ কাটেনি। কারণ বিকল্প নেই। সবাই চাকরিবাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, পড়ালেখা ও চিকিৎসার প্রয়োজনে ঢাকায় ছুটে আসছেন। আর এ শহর থেকে বেরোতে পারছেন না।
ঢাকাকে বাসযোগ্য করার জন্য অতীতে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বায়ুদূষণ কমাতে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল টু-স্ট্রোক ইঞ্জিন। গ্রিন এনার্জি সিএনজি চালু করা হয়েছিল। গত এক যুগ এর ইতিবাচক ফল পেয়েছে ঢাকাবাসী। পানিদূষণ কমাতে বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হলেও ফল শূন্য। ঢাকার যানজট কমানোর জন্য উড়ালসেতু নির্মাণে পাঁচ হাজার কোটি টাকার মতো ব্যয় হয়েছে। কিন্তু ফল প্রায় শূন্য। উড়ালসেতুর এক্সিট পয়েন্টগুলোর অবর্ণনীয় যানজটের ভয়ে এ সেতু তেমন ব্যবহার হয় না। মগবাজার-মৌচাক উড়ালসেতুর একটি লুপ নেমে এসেছে সোনারগাঁও হোটেলের সামনে। এ লুপে প্রতি মিনিটে সর্বোচ্চ দুটি গাড়ি নামে। কিন্তু এটির কারণে রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে গেছে সোনারগাঁও পয়েন্টে। ফলে তীব্র যানজট এখানকার নিত্যসঙ্গী। উড়ালসেতুর আরেকটি লুপ নেমেছে রমনা থানা ভবনের সামনে। সেখানেও একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে উড়ালসেতুর কারণে মগবাজার মোড়ে যানজট অনেকটাই কমেছে। এটি অবশ্য স্বীকার করতে হবে।
ঢাকার যানজট একটি বড় সমস্যা। এর সমাধানে অনেক বড় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কোনোটাই কাজে আসেনি। এখন পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় পায়ে হাঁটার পরিবেশ তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ঢাকার ফুটপাত দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে মানুষ হাঁটতে পারলে যানজট অনেকটা কমে যেত। এ শহরের বড় রাস্তা থেকে রিকশা উঠিয়ে দিতে পারলে যানজট অনেক কমানো যেত। তবে ব্যক্তিগত গাড়ি বৃদ্ধি ঠেকাতেও পদক্ষেপ নিতে হবে। ২০ বছরের পুরোনো গাড়ি ঢাকায় চলতে পারবে না। নতুন গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের পাশাপাশি ডাম্পিংয়ের উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে।
দেশে প্রতিদিন নতুন ও রিকনডিশন্ড গাড়ি রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে। ফলে গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। গাড়ি বাড়লেও সড়ক বাড়ছে না। ফলে নতুন গাড়ি যানজট সৃষ্টিতে ‘অবদান’ রাখছে। দেশে নতুন গাড়ি আসবে। আবার পুরোনো গাড়ি বাতিল হবেÑএটাই কাম্য। কিন্তু পুরোনো গাড়ি ডাম্পিং হচ্ছে কি না, তার খবর রাখে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় সরকারকে ঢাকার যানজট কমাতে পুরোনো গাড়ি চলাচলে নজরদারি বাড়াতে হবে। ফিটনেস সার্টিফিকেট প্রদানকারী কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর হতে হবে। পাশাপাশি পুরোনো গাড়ি ডাম্পিংয়ের পরিকল্পনা নিতে হবে। ভারতের মতো ডাম্পিং কেন্দ্র গঠন করে প্রণোদনা চালু করা গেলে ঢাকার যানজট অনেকটাই লাঘব হবে। এতে পরিবেশেরও উন্নয়ন হবে বলে আশা করা যায়।
বেশ কিছু দেশে জনপ্রতি একাধিক ব্যক্তিগত গাড়ি রয়েছে। সে তুলনায় বাংলাদেশে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার অনেক কম। প্রতি হাজারে গাড়ি ব্যবহারের সংখ্যা তিনজন। তবে ঢাকার হিসাবটা একটু আলাদা। ঢাকায় প্রতি ৫০ জনে গাড়ি ব্যবহারের সংখ্যা একটি। সে হিসাবে ঢাকায় ছয় থেকে সাত লাখ ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করে। তবে প্রতিনিয়ত এ সংখ্যা বাড়ছে। সরকার ইচ্ছা করলে খুব সহজে কিন্তু এ বৃদ্ধি কমাতে পারে। ঢাকায় যার গাড়ি আছে, তিনিই নতুন আরেকটা গাড়ি কিনছেন। কোনো কোনো পরিবারে পাঁচ-ছয়টি গাড়ি রয়েছে। সরকার একই পরিবারে দ্বিতীয় গাড়ি কেনার ওপর ১০ গুণ কর আরোপ করলে, এটি রোধ করা সম্ভব হবে।
ঢাকার যানজট কমাতে এখানে যা কিছু বলা হলো, তা সাময়িক সমাধানের উপায়। দীর্ঘমেয়াদে ঢাকাকে বাসযোগ্য রাখতে হলে ভাবতে হবে অন্য কিছু। ঢাকার পেছনে হাজার কোটি, লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে লাভ হবে না। ঢাকার বুজে যাওয়া খালগুলো আর কখনওই উদ্ধার করা সম্ভব নয়। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর মতো বড় কোনো রাস্তা ঢাকা শহরে নির্মাণ অকল্পনীয়। পাতাল রেল নির্মাণ করে ঢাকার পথচারীদের সুবিধা করে দেওয়া সুদূরপরাহত। তাই ঢাকার বিকল্প ভাবতে হবে। ঢাকার বিকল্প অতি আকর্ষণীয় শহর গড়ে তুলতে হবে। যে শহরে বিশ্বমানের শিক্ষা, চিকিৎসা, আবাসনসহ নাগরিক সুবিধা পাওয়া যাবে। এজন্য সম্পূর্ণ নতুন শহরের প্রয়োজন নেই। দেশের চার বিভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে উন্নত চারটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিজি (বিএসএমএমইউ) ও অ্যাপোলো হাসপাতালের চেয়ে ভালো মানের চারটি হাসপাতাল গড়ে তুলতে হবে। গড়ে তুলতে হবে উন্নত মানের আবাসন। এক্ষেত্রে খুলনা, রাজশাহী, কুমিল্লা ও গাজীপুরকে মেগাসিটি করার পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে এবং তা বাস্তবায়নে নিতে হবে বলিষ্ঠ উদ্যোগ।
উচ্চাভিলাষী হলেও সরকারের এ ধরনের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া জরুরি। চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ও চারটি হাসপাতালের জন্য বাজেট রাখতে হবে আট হাজার কোটি টাকা। যেখানে থাকবে বিদেশি উপাচার্যসহ বিশ্বমানের শিক্ষক। থাকবে উন্নত গবেষণাগার। অচ্ছুৎ সামন্তের মতো করে গড়ে তুলতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়। ডাক্তারও আনতে হবে বিদেশ থেকে। আর পি সাহা সেই চল্লিশের দশকে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে কুমুদিনী হাসপাতালে জার্মানি ও আমেরিকা থেকে ডাক্তার এনে ওটা চালু করেছিলেন। ইচ্ছা থাকলে এখনও এটা সম্ভব।
দেশে অনেক বেশি ব্যয় করে নিম্নমানের শিক্ষা পাচ্ছে বেসরকারি খাতের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। ভারত, মালয়েশিয়া, পূর্ব ইউরোপের চেয়ে বেশি ব্যয় করে চার বছর পর কেবল সার্টিফিকেট পাচ্ছে। উল্লেখ করার মতো আর কিছু পাচ্ছে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ইংরেজি তো দূরের কথা, ঠিকমতো বাংলা লিখতে পারে না। আর বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের অবস্থা ভয়াবহ। পাঁচ বছরে ৩০-৪০ লাখ টাকা খরচ করে নামের সঙ্গে ডাক্তার পদবি দেওয়া ছাড়া তাদের দিয়ে তেমন কিছু হচ্ছে না। দেশের পড়ালেখার মান যদি এ-ই হয়, তাহলে ভবিষ্যতে জাতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এখনই সবখানে দক্ষ ও যোগ্য লোকের অভাব। ডাকসাইটে আমলা, ডাক্তার, শিক্ষক, সিইও নেই। ভবিষ্যতে জাতি তো মেধাশূন্যতায় পড়বে! তাই এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
দেশে অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। অল্প কিছু লোককে সুবিধা দিতে গিয়ে লাখো কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় ক্ষতি করা হয়েছে গত ৯ বছরে। ঘাটে ঘাটে অপচয় করা হয়েছে। যে দেশে শ্রম ও উন্নয়নের বেশিরভাগ কাঁচামাল সস্তা, সে দেশে কীভাবে সড়ক, ফ্লাইওভারসহ যে কোনো প্রকল্পের ব্যয় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি হয়? কিন্তু তা-ই হচ্ছে। ৫০০ কোটি টাকার ফ্লাইওভার আড়াই হাজার কোটি টাকায় শেষ করা হয়েছে। হাজার কোটি টাকার নিচে কোনো প্রকল্পই এখন হাতে নেওয়া হয় না। কেবল ব্যাংক খাতে গত ৯ বছরে চলমান অনিয়মের খেসারত দিতে হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। এ টাকা দিয়ে একটি উন্নত সিটি গড়ে তোলার কাজ শুরু করা যেত। তাই অনিয়ম ও অপচয় কঠোর হস্তে দমন করে অর্থবহ উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলেই কেবল ঢাকা নয়, সারা দেশই আবাসযোগ্য থাকবে। নিজেদের নিয়ে গর্ব করতে পারবে জাতি।
গণমাধ্যমকর্মী
Add Comment