ইসমাইল আলী ও মাসুম বিল্লাহ: অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি প্রতিফলিত হয় কর্মসংস্থানের চিত্রের ওপর। গত এক দশকে এক্ষেত্রে আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। বরং কর্মহীন প্রবৃদ্ধির দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এমনকি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকারি খাতও বড় কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। অথচ পার্শ্ববর্তী ভারত বা শ্রীলঙ্কা এক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে।
যদিও ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির আওতায় সারা দেশে বেকারদের কাজের সুযোগ সৃষ্টির ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। বাস্তবে এটি কাজ করেনি। উল্টো এক দশকে সরকারি খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার কমেছে।
চলতি সপ্তাহে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘সাউথ এশিয়া ইকোনমিক ফোকাস স্প্রিং ২০১৮: জবলেস গ্রোথ?’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে ২০০৫ থেকে ২০১৫ সালের ব্যবধানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে কর্মসংস্থানের গতি-প্রকৃতি পরিবর্তনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি প্রবৃদ্ধির অনুপাতে কোন দেশে কতটুকু কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় তাও দেখানো হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সরকারি খাতে কর্মংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ। এ দেশে সরকারি ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ সৃষ্টির হার মাত্র তিন শতাংশ। বাকি ৯৭ শতাংশ কর্মসংস্থানই হয়েছে বেসরকারি খাতে। অথচ শ্রীলঙ্কায় সরকারি কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার ১৫ শতাংশ। ভারত ও পাকিস্তানে এ হার ছয় শতাংশের বেশি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, সরকারি খাতে কর্মসংস্থান কম হওয়ার বেশকিছু কারণ আছে। এর মধ্যে একটি কারণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য যে হারে রাজস্ব সংহতকরণ (মবিলাইজেশন) ও অবকাঠামো দরকার; সেটা সৃষ্টি হচ্ছে না। তবে সরকারিতে কর্মসংস্থান কম থাকা সবসময় খারাপ নয়। বরং কম মানুষ দিয়ে বেশি মানুষকে সেবা দিতে পারা দক্ষতার বিষয়। তবে সেবার গুণগত দিক বিবেচনায় নিলে ভিন্ন কথা।
তিনি আরও বলেন, সরকারি খাতে কম কর্মসংস্থানের আরেকটি কারণ হলোÑ বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যক্তি খাতনির্ভর। তাই কর্মসংস্থান বহুলাংশে নির্ভর করে ব্যক্তি খাতের ওপর। শিল্প-কারখানা প্রায় সবই বেসরকারি খাতে। রাষ্ট্রীয় শিল্প-কারখানা এখন তেমন একটা নেই। যে কারণে বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরকারি খাতে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি হয় না। যে কারণে সামগ্রিক কর্মসংস্থানে সরকারি খাতের আনুপাতিক হার কমছে। বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় শিল্প-কারখানা বিরাষ্ট্রীয়করণও এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
এদিকে আবার শ্রীলঙ্কায় সরকারি চাকরির মধ্যে আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের হার প্রায় অর্ধেক। ভারত ও পাকিস্তানে এ হার ৩৫ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশে সরকারি চাকরির মধ্যে আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের হার মাত্র ১৫ শতাংশ। বাকি ৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক।
সরকারি ব্যবস্থার মধ্যেও অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের বিষয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে পিএসসির মাধ্যমে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তারা আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের আওতায় আছেন। কিন্তু তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতর মাধ্যমে নিয়োগের অভিযোগ আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জনবল রয়েছে। যে কারণে এক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান বেশি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০০৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে দেশে প্রতি বছর মোট জনসংখ্যার মধ্যে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর হার গড়ে দশমিক ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সময় দেশে মাথাপিছু আয়ও অনেক বেড়েছে। অথচ এ সময়ে প্রতি বছর গড়ে কর্মসংস্থানের হার দশমিক ৫০ শতাংশের বেশি হ্রাস পেয়েছে। নারীদের কর্মসংস্থান এ সময় মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। তবে পুরুষের কর্মংস্থান এক শতাংশ হারে হ্রাস পেয়েছে।
এদিকে ২০০৫ সালে বাংলাদেশে সরকারি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের হার ছিল তিন দশমিক ৫০ শতাংশ। এক দশকের ব্যবধানে তা তিন শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ ২০০৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে সরকারি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের হার কমেছে দশমিক ৫০ শতাংশ। আর এক দশকে পাকিস্তানে সরকারি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের হার কমেছে দশমিক ৬০ শতাংশ। তবে ভারত ও শ্রীলঙ্কায় এ হার বেড়েছে যথাক্রমে দশমিক ৩০ ও এক দশমিক ৫০ শতাংশ।
সরকারি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা ঠিক হবে না বলে মনে করেন ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, দেশটিতে দীর্ঘদিন সরকার শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দিয়ে আসছিল। অর্থাৎ কেউ লেখাপড়া শেষ করে বেসরকারি খাতে বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি জোগাড় করতে না পারলে সরকার তাদের চাকরি দেবে। এ প্রক্রিয়ায় সরকারি কর্মসংস্থান বেড়েছে। তবে এটা সুষ্ঠু ধারা নয়। সরকারের এমন সিদ্ধান্তের কারণে বেসরকারি খাতকে কর্মী পেতে সমস্যায় পড়তে হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে জিডিপির এক শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে কি পরিমাণ কর্মসংস্থান হয় তা ইকেনমেট্রিক মডেলের মাধ্যমে প্রাক্কলন করেছে বিশ্বব্যাংক। এতে দেখা যায়, এক শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির বিপরীতে ভারতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় সাত লাখ ৫০ হাজার। পাকিস্তানে এর পরিমাণ দুই লাখ, বাংলাদেশে এক লাখ ১০ হাজার ও শ্রীলঙ্কায় ৯ হাজার।
এদিকে বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি মাসে এক লাখ ৭০ হাজার কর্মক্ষম জনশক্তি যুক্ত হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিদ্যমান কর্মসংস্থানের হার ধরে রাখতে প্রতি মাসে প্রায় ৯০ হাজার নতুন চাকরি বা কাজের সুযোগ (জব) সৃষ্টি করতে হবে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। এতে বছরে নতুন চাকরি বা কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে ১০ লাখ ৭৫ হাজার। তা না হলে আগামীতে দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে যেতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে।
সরকারি চাকরিতে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ
