নজরুল ইসলাম: সরকারি চার চাকরিজীবীর স্ত্রী মিলে খুলেছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। নাম দিয়েছেন ‘রেক্টো লিমিটেড’। ট্রেড লাইসেন্স অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি প্রথম শ্রেণির ঠিকাদারি, আমদানি-রপ্তানি ও ফার্মেসি ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে ব্যাংক হিসাবের লেনদেন বিশ্লেষণ করে ফার্মেসি ব্যবসা ছাড়া অন্য কোনো ব্যবসার খোঁজ মেলেনি। দলিলপত্র অনুসারে পরিচালকদের মধ্যে আত্মীয়তার কোনো সম্পর্কও পাওয়া যায়নি। তবে তাদের স্বামীরা পরস্পর বন্ধু। প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগ করা অর্থের উৎস নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সম্পর্কিত ৯ ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবের লেনদেন তাদের পেশা বিবেচনায় অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ওই ৯ ব্যক্তির ১৭ ব্যাংকে ৭৭টি হিসাব পাওয়া গেছে। তার মধ্যে দুটি ঋণ হিসাব ও ১১টি ক্রেডিট কার্ড হিসাব। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) তার এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে মানি লন্ডারিংয়ের সন্দেহ আনা হয়েছে। অধিকতর তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠিয়েছে বিএফআইইউ। দুদকের মানি লন্ডারিং অনু বিভাগের কাছে ২০২১ সালের ১৪ জানুয়ারি এক চিঠিতে বিষয়টি অবহিত করা হয়। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এটির অনুসন্ধান শুরু করেছে। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্টদের দুদকে ডাকাও হয়েছে।
দুদক বলছে, স্বামীদের অবৈধ টাকা বৈধ করতে স্ত্রীদের দিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছে তারা। তাদের অবৈধ টাকা সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছে। ২০২১ সালের ১ জুন দুদকের মানি লন্ডারিং অনু বিভাগ থেকে বিএফআইইউর কাছে ব্যাংক হিসাবগুলো ফ্রিজ করার জন্য চিঠিও দেয়া হয়।
রেক্টো লিমিটেড ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ প্রাইভেট কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুস্মিতা সাহানা জামান একজন স্কুলশিক্ষক। তার স্বামী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সহকারী প্রকৌশলী পারভেজ রানা। তার মা সেতারা পারভীন। চেয়ারম্যান জিন্নাত রহমান একজন গৃহিণী এবং আরএম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী। তার স্বামী রবিউল ইসলাম পুলিশের সহকারী সুপার (এএসপি)। তার সঙ্গে যৌথ হিসাবধারী শচীন মৌলিকও এএসপি। পরিচালক সেলিনা খাতুনের পেশা দেখানো হয়েছে আত্মকর্মসংস্থান। তার স্বামী ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সহকারী প্রকৌশলী সাইদুর রহমান। পরিচালক নাজিয়া রহমান পেশায় একজন চিকিৎসক। তার স্বামী সোহানুর রহমান গণপূর্ত অধিদপ্তরে কর্মরত।
বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রেক্টো লিমিটেড ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই সার্টিফিকেট অব ইনকরপোরেশন এবং ১৭ জুলাই ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছে। এ দুটি লাইসেন্স সংগ্রহের আগেই ১২ জুলাই লাজফার্মা লিমিটেডের সঙ্গে ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্যবসার চুক্তি করে। প্রতিষ্ঠানটির লাজফার্মার সঙ্গে করা এ ব্যবসায়িক চুক্তি অস্বাভাবিক।
বিএফআইইউর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিটি ব্যাংকের কাকরাইল ভিআইপি রোড শাখার হিসাবটিতে ২০১৯ সালের ২৩ জুলাই থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত চারটি লেনদেন হয়। পরিচালকদের হিসাব থেকে ট্রান্সফার/ক্লিয়ারিংয়ে মাধ্যমে ২৫ লাখ টাকা করে এক কোটি টাকা জমা হয়। ২০১৯ সালের ৮ ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত হিসাবটিতে চারটি নগদ লেনদেনের মাধ্যমে মোট ৯৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে সুস্মিতা সাহানা জামান দুইবার এবং রবিউল ইসলাম ও পারভেজ রানা একবার করে টাকা উত্তোলন করেছেন।
বিএফআইইউ বলছে, চার পরিচালক তাদের প্রাথমিক বিনিয়োগ জমা করেছেন। আবার কয়েক মাসের ব্যবধানে জমা অর্থের প্রায় পুরোটাই উত্তোলন করেছেন, যা অস্বাভাবিক। তাদের আয়ের উৎস সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য ও দলিলাদি না থাকায় বিনিয়োগ করা টাকার উৎস নির্ণয় করা যায়নি। আবার পুরোটাই উত্তোলন করায় এর ব্যবহার সম্পর্কেও সঠিক ধারণা পাওয়া যায়নি। হিসাবটিতে চলে এমন লেনদেন সন্দেহজনক।
এদিকে লাজ ফার্মা ফ্র্যাঞ্চাইজি নামে দুটি ব্যাংকে দুটি হিসাব পরিচালনার তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মোট এক কোটি সাত লাখ ১৫ হাজার ৮৪১ টাকা জমা এবং এক কোটি দুই লাখ ১৫ হাজার ৬৫ টাকা উত্তোলন করা হয়।
সুস্মিতা সাহানা জামানের নামে সাতটি ব্যাংকে ১৪টি হিসাব পরিচালনার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব হিসাবে ২০১১ সালের আগস্ট থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মোট দুই কোটি ৯৬ লাখ ৪৬ হাজার ৫০৮ টাকা জমা এবং মোট দুই কোটি ৭০ লাখ ৮৮ হাজার ৪৩৮ টাকা উত্তোলন করা হয়। ১৪টি হিসাবের মধ্যে সিটি ব্যাংকের কাকরাইল শাখার দুটি হিসাবে একক লেনদেন পর্যালোচনা করে গ্রাহকের পেশার (শিক্ষক) সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়েছে। হিসাবের অর্থের উৎস স্বামীর আয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তার স্বামী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সহকারী প্রকৌশলী পারভেজ রানা।
পারভেজ রানার নামে ছয় ব্যাংকে মোট ১০টি হিসাব পরিচালনার তথ্য পাওয়া গেছে। এগুলোয় ২০০৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দুই কোটি ৯৭ লাখ ১০ হাজার ৯১ টাকা জমা এবং দুই কোটি ৯৩ লাখ ৮৮ হাজার ৪৬৬ টাকা উত্তোলন করা হয়। হিসাবগুলোয় নগদে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জমা এবং ১৯ লাখ টাকা পর্যন্ত উত্তোলন করা হয়। সম্পাদিত লেনদেন তার পেশা ও অর্থের উৎসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
এছাড়া পারভেজ রানার মা সেতারা পারভীনের নামে তিনটি ব্যাংকে পাঁচটি হিসাব পরিচালনার তথ্য পাওয়া গেছে। হিসাবগুলোয় ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মোট দুই কোটি ৬৬ লাখ ৭৬ হাজার ২৮৫ টাকা জমা এবং দুই কোটি ৪৯ লাখ ৯ হাজার ৬০৯ টাকা উত্তোলন করা হয়। হিসাবগুলোয় পারভেজ রানা ও তার স্ত্রীকে নমিনি করা হয়েছে।
পারভেজ রানা, তার স্ত্রী ও মায়ের ব্যাংক হিসাবগুলো সমন্বিত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০০৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে মোট আট কোটি ৬০ লাখ ৩২ হাজার ৮৮৫ টাকা জমা এবং আট কোটি ১৩ লাখ ৮৬ হাজার ৫১৩ টাকা উত্তোলন করা হয়। পারভেজের স্ত্রী ও মা তাদের হিসাবগুলোয় অর্থের উৎস হিসেবে পারভেজের সরবরাহ করা টাকার কথা বলেছেন। প্রায় সব হিসাবের নমিনিও পারভেজ রানা।
জিন্নাত রহমানের নামে দুটি ব্যাংকে দুটি হিসাব পাওয়া গেছে। এছাড়া তিনি নড়াইলের আরএম এন্টারপ্রাইজের মালিক। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের মগবাজার শাখার হিসাব থেকে ২০১৯ সালের ২৬ জুন থেকে ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ৫৩ লাখ ২৪ হাজার ৫৭০ টাকা জমা এবং ৫৩ লাখ ২০ হাজার ৭১১ টাকা উত্তোলন করা হয়। হিসাবটিতে রবিউল ইসলামের ইউসিবিএল হিসাব থেকে ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর ১০ লাখ টাকা জমা হয়। এছাড়া ইসলামী ব্যাংকের নড়াইল শাখার একটি হিসাবে ২০১৯ সালের ৭ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মোট তিন কোটি ৫৪ লাখ ছয় হাজার টাকা জমা এবং তিন কোটি ৫৪ লাখ এক হাজার ৩১৭ টাকা উত্তোলন করা হয়। হিসাবটিতে নগদে জমা পরপরই সাধারণ একই দিনে উত্তোলন করার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে।
জিন্নাত রহমানের স্বামী এএসপি রবিউল ইসলামের নামে চারটি ব্যাংকে মোট আটটি হিসাবের তথ্য পাওয়া গেছে। ২০০৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এক কোটি ৫৮ লাখ এক হাজার ৯৬৮ টাকা জমা ও এক কোটি ৫৭ লাখ ৪২ হাজার ৮১৯ টাকা উত্তোলন করা হয়। এছাড়া এএসপি শচীন মৌলিকের সঙ্গে রবিউল ইসলামের দুটি যৌথ হিসাব পাওয়া গেছে। এগুলো বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। হিসাব দুটিতে সর্বোচ্চ ২৯ লাখ টাকা জমা এবং এক কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়, যা তাদের পেশার আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এছাড়া দুই সরকারি চাকরিজীবীর যৌথ নামে পরিচালিত হিসাবে বড় ধরনের লেনদেন সন্দেহজনক।
সেলিনা খাতুনের অর্থের উৎস আত্মকর্মসংস্থান বলা হলেও যথাযথ দলিলপত্র সরবরাহ করা হয়নি। তার নামে তিনটি ব্যাংকে পাঁচটি হিসাব পরিচালনার তথ্য পাওয়া গেছে। এগুলোতে ২০০৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এক কোটি ৫৬ লাখ ৫৭ হাজার ৫৬৬ টাকা জমা এবং এক কোটি ৯ লাখ ৮৫ হাজার ৩৮০ টাকা উত্তোলন করা হয়। তার স্বামী সাইদুর রহমান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। তার নামে তিনটি ব্যাংকে তিনটি হিসাব পরিচালনার তথ্য মিলেছে। এগুলোয় ১৯৯৬ সালের নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৩৫ লাখ ৪৭ হাজার ১৮১ টাকা জমা এবং ২৮ লাখ ৫৯ হাজার ১৩৩ টাকা উত্তোলন করা হয়।
নাজিয়া রহমান পেশায় চিকিৎসক। তার নামে তিনটি ব্যাংকে তিনটি হিসাব পরিচালনার তথ্য পাওয়া গেছে। এগুলোয় ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৩০ লাখ ১২ হাজার ৩৭৯ টাকা জমা এবং ২৮ লাখ ৮৭ হাজার ১৯৮ টাকা উত্তোলন করা হয়। তার লেনদেন পেশার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তার স্বামী সোহানুর রহমান পিডবিøউডিতে কর্মরত। তার নামে তিনটি ব্যাংকে আটটি হিসাব পাওয়া গেছে। এগুলোয় ২০০৮ সালের ফেব্রæয়ারি থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মোট এক কোটি ৯৬ লাখ ১৬ হাজার ৬৯৪ টাকা জমা এবং মোট এক কোটি ৯০ লাখ ৯৮ হাজার ১৫১ টাকা উত্তোলন করা হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সহকারী প্রকৌশলী পারভেজ রানা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিএফআইইউয়ের এ প্রতিবেদন সত্য নয়।’ এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সহকারী প্রকৌশলী সাইদুর রহমান ও এএসপি রবিউল ইসলাম কোনো মন্তব্য করেননি।
বিএফআইইউ বলছে, চারজন সরকারি চাকরিজীবীর হিসাব, তাদের স্ত্রীদের হিসাব ও পারভেজ রেজার মায়ের হিসাব এবং তাদের স্ত্রীদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হিসাবে লেনদেন করা অর্থের উৎসের সুস্পষ্ট দলিলপত্র না থাকায় অপরাধলব্ধ (দুর্নীতি ও ঘুষ) আয় লেনদেন করা হয়েছে কি না, সে সন্দেহ রয়েছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২; মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ (সংশোধন) আইন, ২০১৫-এর ২(শ)(১) ধারা অনুযায়ী দুর্নীতি ও ঘুষ সম্পৃক্ত অপরাধ।