মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে সরকারের কাছে ১০ হাজার কোটি টাকার তহবিল চেয়েছিলেন ব্রোকারেজ হাউস মালিক, মার্চেন্ট ব্যাংকারসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। বর্তমানে বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। তবে এই অর্থ পুঁজিবাজারে আসবে কি, আসবে না তা নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। যারা অর্থ চেয়ে আবেদন করেছেন, তারা বলছেন এই অর্থ শিগগিরই পুঁজিবাজারে আসবে। কিন্তু দাতাদের পক্ষ থেকে এখনও কোনো সবুজ সংকেত পাওয়া যায়নি। ফলে বিনিয়োগকারীরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন। এর জের ধরে গতকাল পুঁজিবাজারে আবারও বড় পতন নেমে এসেছে।
মাস খানেকের বিরতি দিয়ে গতকাল আবারও বড় পতন দেখলেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। বড় পতনে একদিনের পতনেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের বাজার মূলধন কমেছে চার হাজার কোটি টাকার বেশি। পাশাপাশি প্রধান সূচকের পতন হয়েছে প্রায় দেড় শতাংশ। ফলে দিন শেষে হতাশ হয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। বাজার ঘুরে না দাঁড়াতেই এই ধরনের বড় পতন তাদের আরও দুচিন্তাগ্রস্ত করে তুলছে।
বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ১০ হাজার কোটি টাকার সরকারি ফান্ডের অর্থ পুঁজিবাজারে আসবেÑএমন প্রত্যাশা ছিল সবার। কিন্তু সম্প্রতি বাজারে গুজব রয়েছে ওই ফান্ড নাও আসতে পারে। গতকাল ব্রোকারেজ হাউসগুলোয় বিনিয়োগকারীরদের মুখে এমন আলোচনা শোনা যায়। অর্থ না এলে বাজার পড়ে যাবেÑএমন শঙ্কায় ভীত হয়ে বিক্রয় আদেশ বাড়তে থাকে। ফলে দিনের বেশিরভাগ সময়ই সূচকের নি¤œমুখী প্রবণতা দেখা যায়, দিনশেষে যা বড় পতনে পরিণত হয়।
বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসইর একজন কর্মকর্তা বলেন, ফান্ড আসবে কি আসবে না, এটা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের চিন্তার কারণ আছে বলে মনে হয় না। এই অর্থ বাজারে এলে এমন আহমরি কিছু হয়ে যাবে তা নয়। অন্যদিকে অর্থ না এলেও পুঁজিবাজারে এর প্রভাব পড়বে না। ফলে তাদের ভয় পেয়ে শেয়ার বিক্রি করার কোনো কারণ নেই।
গতকাল সকাল থেকেই সূচকের নি¤œমুখী প্রবণতা দেখা যায়। দিনশেষে প্রধান সূচক ৬৪ পয়েন্ট কমে স্থির হয় চার হাজার ৩৮৮ পয়েন্টে। শতাংশের হিসাবে পতন হয়েছে প্রায় দেড় শতাংশ। একদিনে সূচকের এ ধরনের পতনকে বড় পতন বলে আখ্যায়িত করেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্ট ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সংশ্লিষ্টদের মতে, একদিনে সূচকের এক শতাংশ কিংবা এর বেশি পতন হলে সেটাকে বড় পতন বলা যায়। বাজারে এমন পতন হলে ঠিক কী কারণে এমন পরিস্থিতি হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা উচিত।
এদিকে পতনের জের ধরে গতকাল লেনদেনও কমে গেছে। গতকাল ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৩৬১ কোটি টাকা। সম্প্রতি লেনদেন ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এর আগে বড় পতনে লেনদেন ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার মধ্যে ছিল।
এদিকে বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি বাজার পতনের কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না এর নিয়ন্ত্রক-সংশ্লিষ্টরা। তাদের অভিমত, পুঁজিবাজার এখন যে পরিস্থিতিতে রয়েছে, এখান থেকে পতন কাম্য নয়। তারা বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য ধারণ করার পরামর্শ দেন। তারা বলেন, আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা অল্পতেই ভয় পান। আর ভয় পেয়ে হাতে থাকা শেয়ার অল্পদরে বিক্রি করে দেন। যে কারণে লোকসান তাদের পিছু ছাড়ে না।
এ প্রসঙ্গে ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীর কাজ হচ্ছে বাজারের যে কোনো বৈরী পরিস্থিতিতেই ধৈর্য ধারণ করা, যা আমাদের দেশে খুব কম দেখা যায়। এখন বাজারে যেসব শেয়ার রয়েছে, তা অধিকাংশই বিনিয়োগ যোগ্য। এসব শেয়ারে দেখেশুনে বিনিয়োগ করতে পারলে যে কেউ ভালো ফল পেতে পারেন। তবে বিনিয়োগ হতে হবে দীর্ঘমেয়াদি।
প্রসঙ্গত, একটার পর একটা পতন দেখতে দেখতে লোকসানের হিসাব কষেই গত বছর পার করতে হয়েছে ২৬ লাখ বিওধারীর। আগের বছরের চলমান পতন এ বছরের শুরুতে আরও ভারী হয়। ফলে নিম্নমুখী হয়ে পড়ে ডিএসইর সূচক, লেনদেন, বাজার মূলধন, বিদেশি বিনিয়োগ, রাজস্ব আদায়সহ সব ধরনের সূচক। যদিও পতনের লাগাম টেনে ধরার জন্য বছরজুড়ে পুঁজিবাজারের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর কিছুই কাজে আসেনি।
এদিকে ২০১৯ সালের প্রথম কার্যদিবসে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের বাজার মূলধন ছিল তিন লাখ ৯১ হাজার ২৮৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। বছরশেষে তা এসে দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৩৯ হাজার ৫৫১ কোটি টাকায়। অর্থাৎ গত বছর ধারাবাহিক পতনের কারণে বাজার মূলধন কমে গেছে প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা। ২০১৮ সালে বছরজুড়ে তালিকাভুক্ত কোম্পানিও ফান্ডের শেয়ার ও ইউনিটের বাজার মূলধন কমে ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে ২০১৯ সালে উল্লেখযোগ্যহারে কমে গেছে ডিএসইর সূচক। গত বছর সূচকের পতন হয় এক হাজার ৪৪ পয়েন্ট। গত বছরের শুরুতে ডিএসইর সূচকের অবস্থান ছিল পাঁচ হাজার ৪৯৬ পয়েন্ট। বছরজুড়ে লাগামহীন পতনের কারণে বছর এসে সূচকের অবস্থান হয় চার হাজার ৪৫২ পয়েন্টে। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে সূচকের পতন হয় ৮৫৮ পয়েন্ট।