সরকারি প্রকল্প বন্ধে ক্ষতিগ্রস্ত যশোরের মাশরুম চাষিরা

মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর: সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ঝড়ে পড়েছেন যশোরের মাশরুম চাষিরা। আত্মকর্মসংস্থানের জন্য উচ্চ পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ মাশরুম চাষে উৎসাহী হয়ে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আর্থিক ক্ষতির কারণে ইতোমধ্যে পেশা ছেড়ে দিয়েছেন অনেকে। দীর্ঘ সাত বছর ধরে সরকারের গৃহীত মাশরুম জোরদারকরণ প্রকল্প বন্ধ থাকায় এক হাজারের বেশি মাশরুম চাষি ঝরে গেছে যশোরাঞ্চলে। পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকে। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এ কৃষকরা শিগগির মাশরুম চাষ সম্প্রসারণে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

কৃষি বিভাগ বলছে, মাশরুমের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে নতুন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, যা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী পরিষদের (একনেক) সভায় পাসের অপেক্ষায় রয়েছে।

জানা গেছে, যশোরে ব্যক্তি উদ্যোগে ২০০১ সাল থেকে কয়েক জন উদ্যোক্তা মাশরুম চাষ শুরু করেন। এরপর ২০০৯ সালে সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় গৃহীত মাশরুম উন্নয়ন ও জোরদারকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে এ অঞ্চলে এর প্রসার হয়। মাশরুম চাষাবাদে উৎসাহী হয়ে এতে জড়িত হন যশোরের এক থেকে দেড় হাজারের বেশি নারী-পুরুষ। তৈরি হয় কয়েকশ’ উদ্যোক্তা। বাসাবাড়ি ও অল্প জায়গার মধ্যে চাষ করে তারা আয় করতে থাকেন লাখ টাকা। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই ২০১৪ সালের জুনে হঠাৎ প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় সরকার। সেই থেকে মাশরুম চাষ থেকে গুটিয়ে নিতে থাকেন বেশিরভাগ কৃষক।

যশোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, যশোর এক সময় মাশরুম চাষের জন্য বিখ্যাত ছিল। জেলা শহরের চাঁচড়া ও মুড়লী এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষিত বেকাররা এ পেশায় যুক্ত হতে থাকেন। বিকাশমান এ শিল্পের সঙ্গে মানুষ যখন যুক্ত হয়ে সাংসারিক জীবনে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে উš§ুখ, ঠিক তখন সরকার কোনো ঘোষণা ছাড়াই মাশরুম জোরদারকরণ প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়।

চাঁচড়া ডালমিল এলাকায় তৌহিদুর রহমান এক সময় মাশরুম চাষ করে ব্যাপক সাফল্য পান। কয়েক দিনের মধ্যে তিনি বড় উদ্যোক্তা বনে যান। প্রকল্প বন্ধ হওয়ার পর থেকে তিনি পেশা বদলে ফেলেছেন। এখন ঝিনাইদহে ছোট ব্যবসা করে তিনি জীবনযাপন করেন।

তিনি বলেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে মাশরুম চাষ করে দাঁড়িয়ে থাকা খুব কঠিন। আমরা দীর্ঘ সাত থেকে ছয় বছর ধরে অপেক্ষা করছি আবার প্রকল্প চালু হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাচ্ছি না। যদিও কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে মাশরুম চাষে সরকার আবার উদ্যোগ নেবে।

একই কথা বলেন, শহরতলীর মুড়লী এলাকার মাশরুম চাষি আইয়ূব আলী। তিনি বলেন, প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার পরও কিছু কিছু উদ্যোক্তা চাষ অব্যাহত রাখলেও বর্তমান বীজ সংকটের কারণে তারা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। আগে যশোর হর্টিকালচার থেকে মাশরুম উদ্যোক্তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। প্রকল্প বন্ধ হওয়ার পর থেকে আর কোনো প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না। সরকারিভাবে উদ্যোক্তাদের মাঝে মাশরুমের বীজ সরবরাহ করা হতো। বর্তমানে বীজ না থাকায় আমাদের ইচ্ছা থাকলেও মাশরুম চাষ করা যাচ্ছে না।

স্কুলজীবন থেকে মাশরুম চাষ শুরু করে এক সময়ে নিজের ভাগ্যে বদলে ফেলেন যশোর বিরামপুরের রিতা রায়। তার দেখাদেখি ওই এলাকায় গড়ে ওঠে মাশরুম পল্লি। বর্তমানে সেখানের কোথাও মাশরুম চাষ হয় না।

রিতা রায় জানান, মাত্র দুই বছর আগেও পুষ্টিকর সুস্বাদু সবজি মাশরুম চাষ জনপ্রিয় ছিল যশোরে। শত বেকার ছেলেমেয়ে এ পেশার সঙ্গে জড়িয়ে মাসে পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় করতেন। অথচ এখানে এখন প্রায় বিলুপ্ত এ চাষ।

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এ অঞ্চলের মানুষের চাহিদা মেটাতে হর্টিকালচার সেন্টারে প্রতিষ্ঠা করা হয় মাশরুম গবেষণাগার। যেখানে প্রতি মাসে সাত হাজার প্যাকেট বীজ উৎপাদন হতো। এসব বীজ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উদ্যোক্তাদের মাঝে বিতরণ করা হতো। বর্তমান প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় গবেষণাগারটিও বন্ধ রয়েছে।

হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা বলেন, মাশরুম জোরদারকরণ প্রকল্পটি আবার কৃষক পর্যায়ে আনার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে এ বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা প্রস্তুত করা হয়েছে, যা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী পরিষদের (একনেক) সভায় উত্থাপনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।

তিনি বলেন, প্রকল্পটি চালু হলে হর্টিকালচার সেন্টারের গবেষণাগারটি আবার চালু হবে। ফিরে আসবে মাশরুম চাষিদের সেই সোনালি দিন।

এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা দীপঙ্কর দাস বলেন, আমরা আশা করছি আগামী চার থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে প্রকল্পটি ফের চালু হবে। কারণ এটি একনেকের সভার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। প্রকল্পটি চালু হলে এ অঞ্চলের ঝড়ে পড়া উদ্যোক্তাদের এ পেশায় আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। সঙ্গে তৈরি হবে নতুন উদ্যোক্তা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০