বীর সাহাবী: দেশের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়ে থাকে সেবাগ্রহীতাদের জন্য। নাগরিকদের পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়ে থাকে। এত সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পরও সরকারের বিশাল পরিমাণের আর্থিক ক্ষতি করেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। যে ক্ষতির কারণে সরকারের কোষাগার থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ লোপাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে সরকারি ঋণের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি ঋণের সুদও পরিশোধ করতে হচ্ছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে বিভিন্ন সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান অনিয়ম করার মাধ্যমে সরকারের প্রায় ২৯ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি করেছে। বিভিন্ন সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহƒত বিভিন্ন আর্থিক বিষয়কে সরকারিভাবে চালিয়ে দেয়ার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারের আর্থিক ক্ষতি করেছেন।
২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য স্বাস্থ্যসেবা খাতে মোট বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ১৯৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এর মধ্য থেকে ২ হাজার ১৩৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা এই খাতে ব্যয় করা হয়েছে, যা মোট বরাদ্দের ৯৭ দশমিক ২ শতাংশ। বরাদ্দকৃত এই অর্থ থেকে ২৮ কোটি ৯৪ লাখ ৮৬ হাজার ৯৩১ টাকার অনিয়ম করা হয়েছে বলে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) ১৩টি আলাদা নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
কোন খাতে কত অনিয়ম: সিএজি কার্যালয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ৮টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ১টি সিভিল সার্জন অফিস, ১টি সদর হাসপাতাল এবং ২টি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ২০১৬-১৭ অর্থবছরের হিসাবে বিল, ভাউচার ও বিল রেজিস্ট্রার পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা গেছে, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও ইডিসিএলের উৎপাদিত পণ্য থাকা সত্ত্বেও উচ্চমূল্যে বেসরকারি কোম্পানির কাছ থেকে এমএসআর কিনেছে। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকার বেশি।
স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা নির্ধারিত হারে বাড়ি ভাড়া ভাতা না দেয়ায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২ কোটি ৬৪ লাখ। সিএজিকে দেয়া জবাবে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এই টাকা আদায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছে। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কোনো জবাব দেয়নি।
স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য বা মালামাল সরবরাহের বিপরীতে পরিশোধিত বিলের ওপর উৎসে আয়কর যথাযথভাবে কর্তন না করার কারণে এ খাতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৭০ লাখ টাকা।
নিরীক্ষায় উঠে এসেছে, পণ্য বা মালামাল সরবরাহের বিপরীতে পরিশোধিত বিলের ওপর উৎসে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) যথাযথভাবে কর্তন না করায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৫৩ লাখ টাকা; যা মাসিক ২ শতাংশ হারে দণ্ডসুদসহ সরকারি কোষাগারে জমাযোগ্য। বিবিধ প্রাপ্তি বাবদ আদায়কৃত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না করায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২২ লাখ টাকা।
সবচেয়ে বড় অনিয়মটি হয় স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয় চাহিদাপত্র না থাকার পরও সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরস ডিপো (সিএমএসডি) তথা কেন্দ্রীয় ঔষধাগার কর্তৃক সরবরাহকৃত যন্ত্রপাতি অব্যবহƒত অবস্থায় পড়ে থাকার কারণে। এই লোকসানের পেছনে রয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, খুলনা মেডিকেল কলেজ, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, রংপুর মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ এবং জাতীয় হƒদরোগ ইনস্টিটিউট। এজন্য সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৫ কোটি টাকার বেশি।
চুক্তির শর্তানুযায়ী ক্রয়কৃত যন্ত্রপাতি ওয়ারেন্টি থাকার সময়কালের মধ্যে নষ্ট হওয়া সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মেরামত না করে জালিয়াতির মাধ্যমে অন্য ঠিকাদার দিয়ে মেরামত করিয়ে ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা লোপাট করা হয়েছে।
যে সংখ্যক রোগী ভর্তি করা হয়েছে, তার থেকে বেশি রোগীর খাবার সরবরাহ ও অতিরিক্ত মূল্যে পণ্য কেনার মাধ্যমে সরকারের ৪৫ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে। এই তালিকায় রয়েছেÑরাজশাহী মেডিকেল কলেজ, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
হাসপাতালের আওতাধীন বিভিন্ন স্থাপনার ভাড়া ঠিকভাবে আদায় না করা বা ভাড়া আদায় করলেও এর নথিপত্র সংগ্রহ না করে অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশে ৪০ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে। এই অনিয়মের পেছনে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছেÑসিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ।
এই প্রকল্পের আওতায় নির্মাণাধীন ভবনের কাজে ব্যবহার করা বিদ্যুৎ ও পানির বিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিশোধ না করে অনিয়মিতভাবে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) মাধ্যমে পরিশোধ করার কারণে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩ কোটি টাকার বেশি। এর মাধ্যমে এই প্রকল্পের অর্থ তছরুপ করা হয়েছে।
মহাখালীতে অবস্থিত জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ২০১৬-১৭ অর্থবছরের হিসাব নিরীক্ষা করে দেখা গেছে, ব্লাড ব্যাগ ও স্যালাইন ব্যাগের উৎপাদন হিসাব ও অন্যতম কাঁচামাল পিভিসি শিটের সরবরাহ যাচাই করে দেখা গেছে, স্যালাইন ব্যাগ ও ব্লাড ব্যাগ উৎপাদন করতে যে পরিমাণ কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়েছে, তা দিয়ে আরও বেশি স্যালাইন ও ব্লাড ব্যাগ উৎপাদন করা সম্ভব ছিল। কিন্তু সেই কাঁচামাল দিয়ে কম পণ্য উৎপাদন করার কারণে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে সাড়ে ২৫ লাখ টাকা।
সরকারি বিভিন্ন সেবার বিপরীতে যে ফি আদায় করা হয়, তা নিয়ে তিনটি মেডিকেল কলেজ, নিটোরের হিসাব নিরীক্ষা করে দেখা যায়, ইউজার ফি যথাযথভাবে আদায় না করায় এ খাতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪৮ লাখ টাকা।
আবাসিক বাসায় কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের ব্যক্তিগত বিদ্যুৎ বিল, রেজিস্ট্রার ও বেতন বিল পরিশোধ না করে জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারি তহবিল থেকে পরিশোধ করার মাধ্যমে ২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা লোপাট করা হয়েছে। এই অর্থ আত্মসাতের পেছনে রয়েছে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, পাবনা মানসিক হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ, রংপুর মেডিকেল কলেজ এবং শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ।
বরাদ্দকৃত অর্থের সঠিক ব্যবহার না করা
২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য স্বাস্থ্যসেবা খাতে মোট বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১৯৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এর থেকে ২ হাজার ১৩৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা এই খাতে ব্যয় করা হয়েছে, যা মোট বরাদ্দের ৯৭ দশমিক ২ শতাংশ। বাকি ৬৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা জরুরি যেসব সেবা রয়েছে, সেগুলোয় ব্যবহার করা হয়নি। বিভিন্ন খাতে প্রয়োজনীয় অনেক সেবা দেয়ার সুযোগ তৈরির রাস্তা না বের করতে পারায় জনগণ অনেক সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তারা একদিকে অর্থ ব্যয় না করে অন্যদিকে বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে সরকারের প্রায় ২৯ কোটি টাকার লোকসান করেছে।