সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ সাড়ে আট লাখ কোটি টাকা ছাড়াল

নিজস্ব প্রতিবেদক: সরকারের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়া পুঞ্জীভূত ঋণ সাড়ে আট লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এক বছরে এ উৎস থেকে সরকারের নেয়া ঋণের পরিমাণ এক লাখ আট হাজার কোটি টাকার বেশি বেড়েছে। ২০২৩ সালের মার্চ সরকারের অভ্যন্তরীণ উৎসের পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ ছিল সাত লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকা, যা ২০২৪ সালের একই মাসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে আট লাখ ৫৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকায়। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়।

এদিকে সরকারের পুঞ্জীভূত ঋণ বাড়লেও চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ অবশ্য অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ কমেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সরকারের অভ্যন্তরীণ উৎসের প্রকৃত ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৬৫ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা। সেই হিসাবে গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ ১৮ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা কমেছে।

বর্তমানে সরকারের পুঞ্জীভূত ঋণের সবচেয়ে বেশি রয়েছে ব্যাংকবহির্ভূত

খাতে। এ খাতে গত মার্চ শেষে ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৩৩ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা। সরকার সঞ্চয়পত্র, বিল ও বন্ড বিক্রি করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকে ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ নেয়। একই সময় পর্যন্ত ব্যাংক খাত থেকে নেয়া ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে চার লাখ ২১ হাজার ৯৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক ও তফসিলি ব্যাংক থেকে সরকারের নেয়া সরাসরি ঋণই হলো ব্যাংক খাতের ঋণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য তফসিলি ব্যাংক থেকে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ঋণ কম নিয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য তফসিলি ব্যাংক থেকে সরাসরি ঋণ নেয়ার পরিমাণ ছিল ৩৪ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ব্যাংকে সরকারের প্রকৃত ঋণ ছিল ৬১ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৯ মাসে এ খাত থেকে সরকারের ঋণ ২৬ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা কমেছে।

গত জুলাই-মার্চ সরকারের ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া কমলেও ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে এ খাত থেকে সরকারের প্রকৃত ঋণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৯৫ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল চার হাজার ৩৪ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, উল্লিখিত ৯ মাসে ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে সরকার মোট ২৪ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা ঋণ করেছে। এর মধ্যে সরকার সঞ্চয়পত্রের আসল বাবদ ১২ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে। ফলে ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে সরকারের প্রকৃত ঋণ কমে ১২ হাজার কোটি ৯৫ টাকায় নেমেছে।

মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় গত জুলাই থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে ঋণ দেয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। ব্যাংক থেকে সরাসরি অর্থ ধার কমলেও চলতি বছরের শুরু থেকে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে সরকারের ধারের পরিমাণ বেড়েছে। এখন তা আরও তীব্র হচ্ছে। সর্বশেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) ব্যাংক খাত থেকে নিট ৬১ হাজার ৩২০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত ২৯ মে পর্যন্ত সরকারের ব্যাংকঋণের মোট স্থিতি দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৫৫ হাজার ৯৮ কোটি টাকায়, গত ৩০ জুন শেষে যা ছিল তিন লাখ ৯৩ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। এ হিসাবে অর্থবছরের প্রথম ১১ মসে সরকারের নিট ব্যাংকঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬১ হাজার ৩২০ কোটি টাকায়। অথচ গত ১ জুলাই থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নেয়া ঋণের স্থিতি ঋণাত্মক ধারায় ছিল প্রায় ছয় হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা।

বিদায়ী বছরের শুরু থেকে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী ধারায় রয়েছে। তাই অর্থনীতিবিদরা ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়া বন্ধের পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়া বাড়লে তা পরোক্ষভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেয়। এ কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে ঋণ দেয়া বন্ধ করে দেয়। এরপরও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। বরং দিন দিন মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাচ্ছে।

এদিকে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট থাকা সত্ত্বেও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা আরও ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। ঘাটতি বাজেট মেটাতে আগামী অর্থবছরে ব্যাংক থেকে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যা ঘোষিত বাজেটের ১৭ শতাংশের বেশি।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। গত বৃহস্পতিবার সংশোধিত বাজেটে এ লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে এক লাখ ৫৫ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান  এবং মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, সরকার টেক্স জিডিপি বাড়াতে না পারার কারণে ব্যাংক থেকে ঋণ করতে হচ্ছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ নেই। তাই সরকারকে ঋণ দিতে পারছে। তার মানি সবসময় দিতে পারবে, তা নয়।

তিনি বলেন, বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ মার্কেট ঠিক হলে তখন বেসরকারি খাতের ঋণের চাহিদা বাড়বে। তখন ঋণ দেয়ার চাপ থাকবে। ওই সময় ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে না পারলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। আর সরকারের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা থাকতে হবে। ব্যাংকঋণ নিয়ে ব্যাংকে শোধ করলে কোনো লাভ নেই।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০