নিজস্ব প্রতিবেদক: আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অঙ্গীকারের ওপর ভিত্তি করে সরকার শিশুদের উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রে শিশুদের উন্নয়নে ২০১৩ সালে শিশু আইন এবং ২০১১ সালে শিশুনীতি প্রণয়ন করা হয়। এছাড়া ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে শিশু বাজেট প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। যদিও পরে শিশুবাজেট প্রণয়নের উদ্যোগ থেমে যায়। সরকারের এতসব উদ্যোগ সত্ত্বেও দেশে শিশুশ্রমের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। শ্রমে নিয়োজিত শিশুরা শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বাইরে থাকছে এবং তাদের একটি বিরাট অংশ এখনও নানা ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত।
জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গতকাল ২০২২ সালে পরিচালিত জাতীয় শিশুশ্রম জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে আসে। বিবিএসের সম্মেলন কক্ষে প্রতিবেদন প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মো. শহীদুজ্জামান সরকার, সম্মানীয় অতিথি ছিলেন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) আবাসিক প্রতিনিধি টুউমো পোওটেনেন, বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন এবং সভাপতিত্ব করেন বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, বর্তমানে দেশে পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশু রয়েছে তিন কোটি ৩৩ লাখ ৬৪ হাজার। এদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের শ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন, যা পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সী মোট শিশুর মধ্যে আট দশমিক ৯ শতাংশ। অথচ ২০১৩ সালে শ্রমে নিয়োজিত মোট শিশুর অনুপাত ছিল আট দশমিক সাত শতাংশ। এ সময়ে মধ্যে শিশুশ্রম বিলুপ্ত হওয়ার কথা থাকলেও উল্টো শ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২২ সালের জরিপ অনুসারে, শ্রমে নিয়োজিত পাঁচ থেকে ১৩ বছরের শিশুর সংখ্যা ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭ জন। এটি ওই বয়সভিত্তিক গোষ্ঠীর মোট শিশুর চার দশমিক চার শতাংশ। ২০১৩ সালে এ হার ছিল চার দশমিক তিন শতাংশ। এক্ষেত্রেও শ্রমে নিয়োজিত শিশুর অনুপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আমার কথা হচ্ছে, বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের নিয়োজন হ্রাস পেয়েছে। ২০১৩ সালে পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের তিন দশমিক দুই শতাংশ ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত ছিল। ২০২২ সালে সেটি হ্রাস পেয়ে দুই দশমিক সাত শতাংশ হয়েছে।
বিবিএসের হিসাব অনুসারে, শ্রমে থাকা শিশুদের মধ্যে ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্যে করে অটোমোবাইল ওয়ার্কশপে কাজ করে সবচেয়ে বেশি। ২০১৩ সালে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ছিল ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু। এক হাজার ২৮৪টি প্রাথমিক নমুনা ইউনিটের (পিএসইউ) ৩০ হাজার ৮১৬টি খানা থেকে সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এই পরিসংখ্যান প্রণয়ন করা হয়েছে।
জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ অনুসারে, পল্লী এলাকায় ২৭ লাখ ৩০ হাজার শ্রমজীবী শিশু রয়েছে এবং শহরাঞ্চলে রয়েছে ৮ লাখ ১০ হাজার। আর পাঁচ থেকে ১৩ বছর বয়সীদের মধ্যে শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা পল্লী এলাকায় ১৩ লাখ ৩০ হাজার এবং শহরাঞ্চলে ৪ লাখ ৪০ হাজার। অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা পল্লী এলাকায় ৮ লাখ ২০ হাজার এবং শহরাঞ্চলে ২ লাখ ৪০ হাজার রয়েছে।
প্রতিবেদনে ৫-১৭ বছর বয়সী শিশুদের জনসংখ্যার পরিসংখ্যানবিষয়ক তথ্য রয়েছে। এই বয়সের মোট শিশু জনসংখ্যা তিন কোটি ৯৯ লাখ ৬০ হাজার। যেখানে পাঁচ থেকে ১১ বছর বয়সী ৫৫ দশমিক দুই শতাংশ। দেশে দুই কোটি ৭৬ লাখ ৩০ হাজার খানায় ৫-১৭ বছর বয়সী শিশু রয়েছে এবং স্কুলে উপস্থিতির হার বর্তমানে ৩৪ দশমিক ৮১ শতাংশ।
জরিপ হতে প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী, শিশু শ্রমিকের ৮২ শতাংশ তাদের নিজস্ব বাড়িতে বসবাস করে, উৎপাদনে ৩৩ দশমিক তিন শতাংশ এবং কৃষি, বনায়ন এবং মাছ ধরায় ২৩ দশমিক ছয় শতাংশ নিযুক্ত রয়েছে। সামগ্রিকভাবে, শিশু শ্রমিক কর্মচারী হিসেবে শ্রেণিভুক্ত ৬৮ দশমিক আট শতাংশ এবং স্কুলে যায় ৫২ দশমিক দুই শতাংশ।
শিশুশ্রমিকদের গড় মাসিক আয় ছয় হাজার ৬৭৫ টাকা। এছাড়া ২০ লাখ ১০ হাজার শিশু গৃহকর্মী রয়েছে, যাদের পারিশ্রমিক দেয়া হয় না এবং ৮০ হাজার যারা পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত, উভয় ক্ষেত্রেই পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি। তিনটি প্রাথমিক সেক্টর যেখানে কৃষি, শিল্প এবং পরিষেবা যথাক্রমে ১০ লাখ ৭০ হাজার, ১১ লাখ ৯০ হাজার এবং ১২ লাখ ৭০ হাজার শিশুশ্রমিক রয়েছে।
সেক্টরভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শিশুশ্রম বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ৪৩টি সেক্টরকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে, বিবিএস সরকার ঘোষিত এই ঝুঁকিপূর্ণ তালিকা থেকে সেক্টরভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শিশুশ্রম জরিপ-২০২৩ পরিচালনার জন্য পাঁচটি খাত নির্বাচন করেছে। এই সেক্টরগুলোকে ফোকাস করে শিশুশ্রম বিরাজমান রয়েছে এবং জরুরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন সে লক্ষ্যকে সামনে রেখেই এ জরিপটি পরিচালনা করা হয়েছে।
এই নির্বাচিত সেক্টরগুলো হলোÑমাছ, কাঁকড়া, শামুক/ঝিনুক সংক্ষরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ও শুঁটকি মাছ উৎপাদন; জুতা উৎপাদন (চামড়ার তৈরি পাদুকা শিল্প); লোহা ও ইস্পাত ঢালাই (ওয়েন্ডিং কাজ বা গ্যাস বার্নার মেকানিকের কাজ); মোটর যানবাহনের রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত (অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ); এবং ব্যক্তিগত এবং গৃহস্থালি সামগ্রীর মেরামত (অনানুষ্ঠানিক এবং স্থানীয় টেইলারিং এবং পোশাক সেক্টর)।
জরিপের প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী, বিবিএসের নির্বাচিত উপরি-উক্ত ৫টি সেক্টরে ৪০ হাজার ৫২৫টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই পাঁচটি ঝুঁকিপূর্ণ খাতে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৩৮ হাজার আটজন শিশু কাজ করছে। ঝুঁকিপূর্ণ সেক্টরে কাজে নিয়োজিত শিশুদের মধ্যে ৯৭ দশমিক ৫ শতাংশ ছেলে এবং ২ দশমিক ৫ শতাংশ মেয়ে শিশু। এই ৫টি সেক্টরে শ্রমজীবী মোট শিশুর সংখ্যা হলো যথাক্রমে শুঁটকি মাছ উৎপাদনে ৮৯৮, চামড়ার তৈরি পাদুকা তৈরিতে ৫ হাজার ২৮১টি, ওয়েল্ডিং বা গ্যাস বার্নার ম্যাকানিকের কাজে ৪ হাজার ০৯৯, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপে ২৪ হাজার ৯২৩ এবং অনানুষ্ঠানিক এবং স্থানীয় টেইলারিং বা পোশাক খাতে ২ হাজার ৮০৫ জন। এ থেকে স্পষ্ট যে, ৫টি ঝুঁকিপূর্ণ খাতের শ্রমজীবী শিশুদের সবচেয়ে বেশি কাজ করে অটোমোবাইল খাতে। পল্লী ও শহর বিবেচনায় এই খাতে কর্মরত শিশুর ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ পল্লী এবং ৬৪.৩% শহর এলাকায় বসবাস করে।