নিজস্ব প্রতিবেদক: বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার বিদায় নেয়ার পর (২০০৬ সাল শেষে) বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ বিলিয়ন ডলারের কিছু কম। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে তা সোয়া দুই বিলিয়ন ডলারের মতো বাড়ে। এতে ২০০৮ সাল শেষে তা দাঁড়ায় ২১ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। তবে আওয়ামী লীগের শাসনামলে তা বেড়ে ৭৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ সাড়ে ১৫ বছরে সরকারের বিদেশি ঋণ বেড়ে পৌনে চারগুণ হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০০৮ সাল শেষে সরকারের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ২১ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দায়িত্ব নেয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। পরের পাঁচ বছরে সরকারের বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পায় ৬ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার। এতে ২০১৩ সাল শেষে সরকারের বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ২৭ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার।
ওই পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৯ সালে সরকারের বিদেশি ঋণ ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন বাড়লেও ২০১০ সালে তা প্রায় ৬৭৫ মিলিয়ন ডলার হ্রাস পায়। তবে পরের বছর তা প্রায় ৭২৯ মিলিয়ন ডলার বাড়ে। যদিও ২০১২ সালে বাড়ে প্রায় ১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ও ২০১৩ সালে প্রায় ৩ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার।
২০১৪ সালে আবারও ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। এর পরের পাঁচ বছরে (২০১৪-২০১৮ সাল) দ্রুত বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পায়। ওই পাঁচ বছরে সরকারের বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পায় ১৬ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার বা ৬০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সাল শেষে সরকারের বিদেশি ঋণ স্থিতি দাঁড়ায় ৪৪ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। ওই পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৪ সালেই বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি পায় ২ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। তবে পরের বছর তা মাত্র ৩১ মিলিয়ন ডলার বাড়ে। ২০১৬ সালে বিদেশি ঋণ বাড়ে ১ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার, ২০১৭ সালে রেকর্ড ৬ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ও ২০১৮ সালে ৫ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের পাঁচ বছরে (২০১৯-২০২৩) বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ সময় বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৩৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৭৯ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭৯ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। এ পাঁচ বছরের মধ্যে ২০১৯ সালে বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৫ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে বৃদ্ধি পেয়েছে ৮ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ২০২১ সালে তা বৃদ্ধি পেয়েছে ৯ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ২০২২ সালে সরকারের বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৪ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার ও ২০২৩ সালে বেড়েছে সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার, যা তৃতীয় সর্বোচ্চ।
যদিও চলতি বছর প্রথম তিন মাসে সরকারের বিদেশি ঋণ কিছু হ্রাস পেয়েছে। গত মার্চ শেষে সরকারের বিদেশি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭৯ বিলিয়ন ডলার। জুনের তথ্য এখনও প্রকাশ করা হয়নি। তবে এপ্রিল-জুন সময়ে অর্থবছরের শেষ প্রান্তিক হওয়ায় ওই তিন মাসে বিদেশি ঋণ বাড়বে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এ সময় সরকারের ঋণ ৮০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর শেয়ার বিজকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার গত কয়েক বছর অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের জন্য বিদেশি ঋণ নিয়েছে। বিদ্যুৎ খাতেও বিপুল পরিমাণ বিদেশি ঋণ নেয়া হয়। এর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প অন্যতম। আবার পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেলসহ বড় বড় কিছু প্রকল্প এখনই দরকার ছিল না। কোনো প্রকার স্টাডি ছাড়া হঠাৎ করেই এসব প্রকল্প নেয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে যেন বড় অপরিকল্পিত প্রকল্প না নেয়া হয়, নতুন সরকারকে সে বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। যেকোনো বড় প্রকল্প নিলে ভেবেচিন্তে নিতে হবে। সস্তায় যদি জাপানিরা কোনো প্রকল্প করে দেয়, তা নেয়া যায়। তবে চীনের ঋণের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তারা যদি সস্তায় ঋণ দেয়, তাহলে সেটা নেয়া যাবে। তবে বর্তমানে যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ রয়েছে, তা পরিশোধে চাপে পড়বে দেশ। তাই আগামীতে কীভাবে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ানো যায়, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে।