নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে গত এক বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান করছে। ফলে মানুষের সঞ্চয় ক্ষমতা কমেছে। এ সময় রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির কারণে বাজার থেকে টাকা উঠে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। ফলে বেশিরভাগ ব্যাংক এখন তারল্য সংকটে ভুগছে। এ পরিস্থিতিতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা আরও ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। ঘাটতি বাজেট মেটাতে আগামী অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যা প্রস্তাবিত বাজেটের ১৭ শতাংশের বেশি।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। গতকাল সংশোধিত বাজেটে এ লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) ব্যাংক খাত থেকে নিট ৬১ হাজার ৩২০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। সরকার চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাস পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার চেয়ে পরিশোধ করছিল বেশি। তবে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ পাওয়া, আশানুরূপ রাজস্ব আদায় না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে এখন ঋণ দ্রুত বাড়ছে।
সরকারের অর্থ সংকট তীব্র হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্যও রেকর্ড ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি রেখে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ ধরা হয়েছে ঘাটতি বাজেট। রেকর্ড ঘাটতি বাজেট পূরণে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা দেশের ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ার কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের ৭২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকার দীর্ঘমেয়াদি। আর বাকি ৬৪ হাজার ৮১৮ কোটি টাকার স্বল্পমেয়াদি।
জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান এবং মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, সরকার ট্যাক্স জিডিপি বাড়াতে না পারার কারণে ব্যাংক থেকে ঋণ করতে হচ্ছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ নেই। তাই সরকারকে ঋণ দিতে পারছে। তার মানে সবসময় দিতে পারবে; তা নয়।
তিনি বলেন, বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ মার্কেট ঠিক হলে তখন বেসরকারি খাতের ঋণের চাহিদা বাড়বে। তখন ঋণ দেয়ার চাপ থাকবে। ওই সময় ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে না পারলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। আর সরকারের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা থাকতে হবে। ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যাংকে শোধ করলে কোনো লাভ নেই।
ঘাটতি বাজেট মেটাতে ব্যাংক ছাড়াও অভ্যন্তরীণ উৎস আর্থিক খাত, সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে জনগণের কাছ থেকে সরকার ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। আগামী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা এবং অন্য খাত থেকে ৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। যদিও এখন সঞ্চয়পত্রে সরকারের ঋণ ঋণাত্মক রয়েছে ৭ হাজার ৩১০ কোটি টাকা।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের ঘাটতি বাজেট মেটাতে সরকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে অভ্যন্তরণী উৎস হতে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি এবং বিদেশি উৎস হতে ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী মূলত গত এক বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেছেন। আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে অন্যান্য দেশ কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশেও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে সুদের হার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। নীতি সুদহার সাড়ে ৮ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে এবং নীতি সুদহার করিডরের ঊর্ধ্বসীমা স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি ১০ শতাংশে ও নিম্নসীমা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি ৭ শতাংশে উন্নীত করে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলভিত্তিক সুদের হার নির্ধারণের ব্যবস্থা (স্মার্ট) বিলোপ করে সুদের হার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে।’
অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ‘ব্যাংক খাতে ঋণের চাহিদা ও ঋণযোগ্য তহবিলের জোগান সাপেক্ষে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণের সুদ হার নির্ধারিত হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির আওতায় গৃহীত পদক্ষেপসমূহের সাফল্য নিশ্চিত করার জন্য এর পাশাপাশি রাজস্ব নীতিতেও সহায়ক নীতিকৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিতে ফ্যামিলি কার্ড, ওএমএস ইত্যাদি কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। আমাদের গৃহীত এসব নীতি-কৌশলের ফলে আশা করছি, আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নেমে আসবে।’
দেশে ১৪ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর। গত মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ।