নিজস্ব প্রতিবেদক: বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারের দেয়া মূল্যস্ফীতির হিসাব অবাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত নয় বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেছেন, সরকার ৬ দশমিক ২২ শতাংশের যে মূল্যস্ফীতির কথা বলছে, বাস্তবতার সঙ্গে তার আদৌ মিল নেই। ধারণা করা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। এ মূল্যস্ফীতি সামনের দিনগুলোয় আরও বাড়বে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন।
গতকাল সোমবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনে তিনি এ কথা বলেন। ‘বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, জাতীয় বাজেট ও অসুবিধাগ্রস্ত মানুষের প্রত্যাশা’ শীর্ষক এই বিফ্রিংয়ে সভাপতিত্ব করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘সরকার মূল্যস্ফীতির হিসাব প্রকৃত বাস্তবতার সঙ্গে আদৌ মেলে না। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যস্ফীতির হার অনেক বেশি। যেমন ভোজ্যতেল ও পাম ওয়েলের দাম বেড়েছে ৬১ শতাংশের ওপর। আটা-ময়দার মতো পণ্যের দামও ৫৮ শতাংশ বেড়েছে। তবে মোটা চালের দাম বাড়েনি। কিন্তু মাঝারি বা সুগন্ধি চালের দাম অনেক বেড়েছে। সার্বিকভাবে তেল, ডাল, ডিম, মুরগি ও মাছসহ ইত্যাদি পণ্যের দাম বাড়ার যে হার দিচ্ছে টিসিবি, তা বিবিএসের দেয়া তালিকার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গেও মেলে না। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ধারণা, মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। আগামী দিনে এই ধারা অব্যাহত থাকবে। বিশ্ববাজারে যে পণ্যের দাম বেড়েছে, সেই পণ্য এখনও দেশের বাজারে আসেনি। সেগুলো যখন আসবে, তখন নিত্যপণ্যের দাম আরেক দফা বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘এখন টাকার আমানতে গড় সুদের হার ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। কিন্তু মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকে টাকা রাখলে প্রতি বছর প্রকৃত মূল্য দুই শতাংশ করে কমে যাবে। এটা বড় ধরনের সঞ্চয়বিরোধী। আগামীতে টাকার মান অবশ্যই নিম্নমুখী হবে। তাই অবশ্যই সুদের হার বাড়াতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতিকে ধরে রাখতে হলে, মূল্যস্ফীতিকে কেন্দ্র করে পরিকল্পনা সাজাতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নষ্ট হলে গরিব, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ তাদের আয় পণ্যমূল্যের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে না।’
সামষ্টিক অর্থনীতির ভেতরে বড় ধরনের টানাপড়েন দেখা দিয়েছে উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বিগত বছরে আমাদের আর্থিক যে আয়-ব্যয়ের হিসাব রয়েছে, তা সব সময়ই দুর্বল ছিল। দুর্বলতার লক্ষণ হচ্ছে আমাদের কর জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশের ওপরে ওঠেনি। একইসঙ্গে উন্নয়ন ব্যয়ের চেয়ে পরিচালন ব্যয় বা অপারেটিং ব্যয় অনেক বেশি। দেশে কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা হলো একদিকে অর্থের অভাব, অন্যদিকে সম্পদ থাকলেও তা যথোপযুক্তভাবে খরচ করতে না পারা।’
দেবপ্রিয় বলেন, ‘বৈদেশিক রিজার্ভ নিয়ে আমাদের এক ধরনের আত্মতুষ্টি ছিল। কিন্তু একটি বিষয় লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকেই কমার ধারা শুরু হয়েছে। আমাদের বর্তমানে যে মজুত আছে, তা দিয়ে ৪ থেকে ৫ মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববাজারে দ্রব্যমূল্য যদি আরও বাড়তে থাকে, তাহলে আমাদের রিজার্ভের ওপর বড় ধরনের টান পড়বে। বাজার স্থিতিশীলতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার ছাড়ার সক্ষমতা থাকছে না। এর ফলে টাকার পতনের ধারা অব্যাহত থাকবে। ইতোমধ্যে টাকা ও ডলারের বিনিময় হারে বড় ধরনের পার্থক্য হয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘সরকার পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়াতে চাচ্ছে। কিন্তু এই মুহূর্তে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো অনুচিত হবে। তবে প্রান্ত্রিক ও দুস্থ জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ প্রণোদনা রাখতে হবে। সুরক্ষাভাতা বৃদ্ধি করতে হবে। আগামী দিনে ভর্তুকি ও পিছিয়ে পড়া মানুষের প্রণোদনা অব্যাহত রাখা কঠিন বিষয় হয়ে যাবে।
২০১৮-১৯ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা যেমন ছিল, সে অবস্থায় আমরা এখনও যেতে পারিনি। এ ঘাটতি নিয়ে আমাদের আগামী বাজেটে যেতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে ঊর্ধ্বগতি দেশীয় বাজারে ঊর্ধ্বগতি এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে; যা দিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছর শুরু করতে হবে। সুতরাং এ বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে আগামী বাজেট করতে হবে, সেখানে গরিব মানুষের কণ্ঠস্বর থাকতে হবে। তা না হলে আপনি যতই বরাদ্দ দেন সেই বরাদ্দ সঠিক ব্যবহার হবে না।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেনÑঅ্যাকশনএইড বাংলাদেশের পরিবেশ, জলবায়ু ও সবুজ অর্থনীতির কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রুমানা হক। নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সমন্বয়ক আনিসাতুল ফাতেমা ইউসুফ প্রমুখ।