নিজস্ব প্রতিবেদক: টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনে সব শ্রেণির নাগরিকের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। কিন্তু বর্তমানে এমন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে, যেখানে সমাজের অগ্রায়নে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত। দেশটা চলে গেল কালোটাকার মালিকদের হাতে। কালোটাকার মালিকদের আরও বেশি সুযোগ করে দিচ্ছে সরকার। ফলে নাগরিকদের কাজ করার সুযোগ নেই বললেই চলে। এছাড়া সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে মানুষের সেবাপ্রাপ্তি অত্যন্ত দুরূহ এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও মানুষের দুর্দশার বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখেন না। এমন পরিস্থিতিতে এসডিজির বাস্তবায়ন কঠিন হবে।
রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে গতকাল এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ আয়োজিত জনশুনানিতে বক্তারা এমন মন্তব্য করেন। জনশুনানিতে সভাপতিত্ব করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। উপস্থিত ছিলেন সাবেক সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা, গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম, সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, নাট্যকার মামুনুর রশিদ, সংগীতশিল্পী রিজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্ল্যাটফর্মের সমন্বয়ক আনিসাতুল ফাতেমা ইউসুফ ও সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘আমি উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী জেলার মানুষ। আমার এলাকায় একসময় মানুষের প্রচণ্ড অভাব ছিল। মঙ্গা নামে পরিচিত সেই অভাব সবচেয়ে তীব্র হতো আশ্বিন-কার্তিক মাসে। মানুষ বলত, হাতি ঠেলা যায়, কিন্তু কার্তিক ঠেলা যায় না। কিন্তু এখন আর সেই মঙ্গা নেই। নতুন প্রজš§ মঙ্গা কি জিনিস, তা জানেই না। মঙ্গা এখন জাদুঘরে ঢুকে গেছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, দেশের সব উন্নয়ন একলা সরকারের পক্ষে করা সম্ভব নয়। সব নাগরিককে এক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
আসাদুজ্জামান নূরের বক্তব্যের প্রত্যুত্তরে নাট্যকার মামুনুর রশিদ বলেন, সংসদ সদস্য এসডিজি অর্জনে সবাইকে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। আমরাও সবাই মিলে কাজ করতে চাই। কিন্তু সুযোগটা কোথায়? তিনি বলেন, ‘দেশটা চলে গেছে কালো টাকাওয়ালাদের দখলে। সরকার কালোটাকাওয়ালাদের আরও বেশি লুটপাট করার সুযোগ করে দিচ্ছে। ফলে সাধারণ নাগরিকদের কাজ করার সুযোগ সীমিত হয়ে আসছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, ঘুষ না দিলে কোনো সরকার প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা পাওয়া যায় না। তিনি নিজেও নিজ এলাকার ডিসি অফিসে ঘুষের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন। সরকারি কর্মচারীদের একপ্রকার জমিদারি দিয়ে দেয়া হয়েছেÑউল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ডিসিদের হাতে কেন এত ক্ষমতা দিতে হবে? ডিসিদের আচরণ দেখলে মনে হয় যেন তারা ব্রিটিশ ভাইসরয়ের প্রতিনিধি। একটি স্বাধীন দেশে তারা ঔপনিবেশিক আমলের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করেন।’ স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি সব সেবা ডিসিদের হাতে কুক্ষিগত করে রাখা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগ নেই। সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে সরকারি কর্মচারীদের কেন্দ্র করে।
জনশুনানিতে মূলত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা নানা জনগোষ্ঠীর মানুষের বক্তব্য শোনা হয় এবং নীতিনির্ধারক পর্যায়ে সরাসরি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর দাবি ও চাওয়াগুলো তুলে ধরা হয়। প্রারম্ভিক বক্তব্যে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, গত জুন থেকে দেশের সাতটি স্থানে ২৫টি জেলার পাঁচ শতাধিক নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি বিভিন্ন সংলাপে অংশ নেন। সেসব সংলাপে ছয়টি কমন বিষয় উঠে এসেছে। সে বিষয়গুলোর পাশাপাশি এসডিজি অর্জনে স্থানীয় সমস্যাগুলো নীতিনির্ধারকদের সামনে তুলে ধরার লক্ষ্যে আজকের এ সংলাপ আয়োজন করা হয়েছে। এ সংলাপে মূলত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা প্রতিনিধিদের বক্তব্য শোনা হবে।
সংলাপে অংশ নেয়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী, দলিত শ্রেণির প্রতিনিধি, কৃষক, শ্রমিক, জেলে, তাঁতি, তরুণ সমাজ, হিজড়া, ট্রান্সজেন্ডার, চা শ্রমিক প্রভৃতি শ্রেণি-পেশার মানুষ তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করেন। আলোচনায় সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় চা শ্রমকি এবং সমতল ও পাহাড়ি অঞ্চলের আদিবাসীদের ভূমির অধিকারের বিষয়টি। আলোচকরা মাদক সমস্যা সমাধান, শিক্ষার মানোন্নয়ন, শহরের বিদ্যালয়গুলোয় পর্যাপ্ত খেলার মাঠ প্রতিষ্ঠা, বেদখল হওয়া খেলার মাঠ পুনরুদ্ধার, পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন, চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে ঘুষ বাণিজ্য রোধ করা, সরকারি সেবাপ্রাপ্তি সহজ করা, নির্বাচন ব্যবস্থা ঠিক করা, গণতন্ত্রের চর্চা জোরদার করা প্রভৃতি বিষয়ের ওপর জোর দেন।
আনু মুহাম্মদ বলেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগোষ্ঠী এখনও জাতি হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। এ জন্য তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। তিনি বলেন, সঠিকভাবে যদি নির্বাচন না হয়, তাহলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আসনে বসে থাকা ব্যক্তিরা কীভাবে মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবেন? কাজেই নির্বাচনটা সঠিকভাবে করতে হবে।
রুমিন ফারহানা বলেন, আমার বাবা যেহেতু ফুলটাইম রাজনীতিবিদ ছিলেন, তাই সংসার চালানোর মতো রোজগার করার সময় ছিল না। তাই আমার মাকে বিয়ের সময় শর্ত দিয়েছিলেন তাকেই (মাকে) সংসারের ব্যয় বহন করতে হবে। তিনি বলেন, অথচ এখন তার আশাপাশের রাজনীতিবিদ সহকর্মীদের দিকে তাকালে দেখতে পান, তারা কেউ বন খেকো, কেউ বালু খেকো, কেউ নদী খেকো, কেউবা ব্যাংক খেকো। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার মালিক তারা।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, রাজনীতি করার জন্য তার বাবাকে প্রায়ই গ্রেপ্তার ও জেলে যেতে হয়েছে। কিন্তু সেটা নিয়ে তার পরিবারের কোনো উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠা ছিল না। কারণ তারা জানতেন মেয়াদ শেষে তাদের বাবা জেল থেকে ফেরত আসবেন। কিন্তু এখন সেদিন নেই। রাজনীতি করতে গিয়ে কেউ গ্রেপ্তার হলে পরিবার আতঙ্কে থাকে, কারণ মানুষ হারিয়ে যায়। তাদের আদালতে হাজির করা হয় না। এখনও অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, এসডিজি অর্জনে সবার সম্পৃক্ততা প্রয়োজন, প্রত্যেকের স্বক্রিয় অংশগ্রহণ এসডিজি অর্জন ত্বরান্বিত করবে। তাই সরকার সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। মন্ত্রী জানান, দারিদ্র্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সকল ক্ষেত্রে স্থায়ী উন্নয়ন করতে আমাদের দীর্ঘ মেয়াদে ধাপে ধাপে আগাতে হবে। প্রতি ৬ হাজার মানুষের জন্য ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কমিউনিটি হাসপাতাল গড়ে তোলেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য কমিউনিটি হাসপাতাল কাজ করছে। তিনি বলেন, দেশে দুর্নীতি, সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন সমস্যার শতভাগ সমাধান হয়নি। তবে বর্তমান সরকারের অনেক অর্জন রয়েছে। সমালোচনা করার সুযোগ থাকলেও এই সরকারের অভূতপূর্ব উন্নয়ন অস্বীকার করা উচিত নয়।