শেয়ার বিজ ডেস্ক:কভিডের প্রভাবে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে বিপর্যয় বেড়েই চলছে। ফলে যন্ত্রাংশ ও সেমিকন্ডাক্টর (চিপ) সংকটে দিন দিন উৎপাদন হ্রাস করতে হচ্ছে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে। যন্ত্রাংশ ও চিপ সংকটের মারাত্মক প্রভাব পড়ছে জাপানি ভারী শিল্প খাতে। ফলে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে জাপানের গাড়ি উৎপাদন খাত বড় ধাক্কা খেয়েছে। সেপ্টেম্বর শেষে জাপানের আটটি বৈশ্বিক অটোনির্মাতা কোম্পানির সাতটিরই উৎপাদন হ্রাস করতে হয়েছে। যদিও দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে এ সংকট সাময়িক, কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী বছরের শেষ নাগাদ অব্যাহত থাকবে এ সংকট। খবর: রয়টার্স।
গতকাল বৃহস্পতিবার জাপানের অন্যতম শীর্ষ গাড়ি উৎপাদনকারী টয়োটা করপোরেশন চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিক গাড়ির যন্ত্রাংশ ও চিপ সংকটের কারণে সেপ্টেম্বরে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৯ দশমিক এক শতাংশ উৎপাদন হ্রাস পেয়ে পাঁচ লাখ ১২ হাজার ৭৬৫ ইউনিটে দাঁড়িয়েছে, যা টানা দুই মাস উৎপাদন হ্রাস। টয়োটা বলছে, চলতি বছরের আগস্টেও তাদের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছিল।
এদিকে গতকাল এক প্রতিবেদনে জাপানের আরেক অটোনির্মাতা কোম্পানি নিসান মোটরস জানিয়েছে, বৈশ্বিক উৎপাদেন সেপ্টেম্বরে টানা তৃতীয় মাসে ২৭ দশমিক ৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। যেখানে হোন্ডা মোটরস টানা চতুর্থ মাসে সেপ্টেম্বরে ৩০ শতাংশ উৎপাদন হ্রাস পেয়েছিল। গড়িনির্মাতারা আগেই ধারণা করেছিলেন যে, নিসান মোটরের সঙ্গে হিটাসি মোটর একীভূত হলে উৎপাদন হ্রাস পাবে, কারণ হিটাসির সরবরাহ বিপর্যয় রয়েছে।
এদিকে বুধবার এক প্রতিবেদনে হিটাসি জানায়, ২০২২ সালের মার্চ শেষেও তাদের বর্তমান মুনাফা হ্রাস পাবে। এ বিষয়ে হিটাসির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) ইয়োশিহিকো কাওয়ামুরা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আমাদের উৎপাদনে চিপ ঘাটতি সম্ভবত দ্বিতীয় প্রান্তিক থেকে তৃতীয় প্রান্তিকে বেশি।
জাপানের শীর্ষ বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ক্যানন ইনকরপোরেশন তাদের ২০২১ সালের মোট সম্ভাব্য মুনাফার ১১ বিলিয়ন ইয়েন (৯৭ মিলিয়ন ডলার) কমিয়ে দিয়েছে। কারণ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ফের কভিডের সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে কারখানার উৎপাদিত পণ্য বিক্রিতে বিঘœ দেখা দিয়েছে।
এর আগে এশিয়ার অনেক দেশে কভিড সংক্রমণ কমতে থাকায় কিছু বিশেষজ্ঞ ধারণা করেছিলেন, সামনের মাসগুলোয় সরবরাহ তুলনামূলকভাবে সহজ হবে। টয়োটাও আশা করছে, আগামী নভেম্বরে তাদের উৎপাদন বেড়ে সাড়ে আট লাখ থেকে ৯ লাখ ইউনিটে পৌঁছাবে। কিন্তু সে আশায় হয়তো গুড়ে বালি দেখা দিতে পারে।
ফলে উৎপাদন বিপর্যয় জাপানি অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। কারণ কভিড মহামারি থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য জাপানের রপ্তানি বাড়াতে হবে। যেহেতু উৎপাদন বিপর্যয় চলছে, ফলে রপ্তানি বৃদ্ধির আশাও ক্ষীণ, যা জাপানের অর্থনীতির জন্য একটি বড় ধাক্কা।
এদিকে উৎপাদন নিম্নমুখী হওয়ায় জাপানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ব্যাংক অব জাপান) চলতি বছরের আর্থিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসে প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দিয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই বছরের দুর্বল ব্যয় এবং সরবরাহের সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করেছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী অর্থবছরের জন্য তার প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস বাড়িয়েছে এবং রপ্তানি ও উৎপাদন ধীরগতিকে ‘অস্থায়ী’ বলে উল্লেখ করেছে।
তারপরও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক করে বলেছে, যদি সরবরাহের বাধা প্রত্যাশার চেয়ে ‘আরও খারাপ’ বা বেশি সময় ধরে থাকে এবং ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে থাকে তবে আর্থনীতির জন্য আরও খারাপ সময় আসছে।
এদিকে বুধবার নিক্কেই এশিয়া এক প্রতিবেদনে জানায়, কভিডের প্রভাবে জাপানের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ঋণের বোঝা বাড়িয়েছে, যা কোম্পানিগুলোকে দেউলিয়া হওয়ার পথে ঠেলে দিয়েছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, চলতি বছরের মার্চ শেষে কোম্পানিগুলোর কর, সুদ ও অন্যান্য খরচসহ ঋণের বোঝা চার দশমিক ৯ গুণে দাঁড়িয়েছিল। এর আগে ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দার প্রভাবে ২০০৯ সালের মার্চ শেষে ঋণের পরিমাণ ছিল পাঁচ দশমিক দুই শতাংশ। ঋণের এ চিত্রটি কোম্পানিগুলোকে দেউলিয়া হওয়ার পথে এগিয়ে দিচ্ছে।
টোকিও শকো রিসার্চের মতে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) ২৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠানকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়েছে, যার সংখ্যা দুই হাজার ৯৩৭টি। যদিও উচ্চ বেকারত্বের কারণে ২০০৯ সালে ১৫ হাজারের বেশি কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল।