ফলন বৃদ্ধি, সঙ্গে বাড়তি লাভ মধু। তাই রবিশস্য সরষের সঙ্গে মৌমাছি পালন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন উপজেলায়।
জেলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ এখন সরষের হলুদে ভরে গেছে। সরষে ফুলের মধুু সংগ্রহে এসব জমির পাশে পোষা মৌমাছির শত শত বাক্স নিয়ে হাজির হচ্ছেন মৌয়ালরা। ওইসব বাক্স থেকে হাজার হাজার মৌমাছি বের হয়ে মধু সংগ্রহে ঘুরে বেড়াচ্ছে মাঠে। এখানকার মধু দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ ভারত, মালয়েশিয়া, কুয়েতসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে।
টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকার সরষে ক্ষেতে গিয়ে দেখা যায়, মৌয়ালদের বাক্স থেকে দলে দলে উড়ে যাচ্ছে মৌমাছি। ঘুরে বেড়াচ্ছে ফুলে ফুলে। আর সংগ্রহ করছে মধু। মুখভর্তি মধু সংগ্রহ করে মৌমাছিরা ফিরছে বাক্সে রাখা মৌচাকে। সেখানে সংগৃহীত মধুু জমা করে আবার ফিরে যাচ্ছে সরষে ক্ষেতে। এভাবে দিনব্যাপী মৌমাছি যেমন মধু সংগ্রহ করে। ফুলে ফুলে ঘুরে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে পুরো জমির পরাগায়নেও সহায়তা করে। এ মৌসুমে মৌয়ালরা পোষা মৌমাছি দিয়ে প্রচুর মধু উৎপাদন করে যেমন লাভবান হচ্ছেন ঠিক তেমনি মৌমাছির ব্যাপক পরাগায়নে সরষের বাম্পার ফলন হওয়ার সম্ভাবনায় চাষিরাও বাড়তি আয়ের আশা করছেন।
শুধু তা-ই নয়, বেকার যুবকরা এখন নিজের অর্থ উদ্ভাবনী চিন্তা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিনিয়োগ করেছে সরষে ক্ষেতে মৌমাছি পালন ও মধু উৎপাদন খাতে। সরষে ক্ষেতের পাশে মৌমাছি পালনের কারণে ক্ষেতে কোনো কীটনাশক ব্যবহার করা লাগে না। এছাড়া সরষে ফসলের ক্ষেতের পাশে মৌ চাষ করলে কোনো বাধা ছাড়াই ফুলের পরাগায়ন সম্ভব হয়। ফসল তুলনামূলক বেশি হয়। এছাড়া ক্ষেতের পাশে বাক্সে মৌমাছি পালন করে মধু উৎপাদন ও হচ্ছে নির্বিঘেœ।
ময়মনসিংহের গফরগাঁও থেকে টাঙ্গাইলের বাসাইলে মধু চাষ করতে আসা মৌচাষি রফিকুল ইসলাম জানান, গত ৮ বছর ধরে এ মধু চাষ করছেন তিনি। বিএ পাস করার পর কোথাও কর্মসংস্থানের সুযোগ না পাওয়ায় এ পেশায় এসেছেন তিনি। মিলিফেরা নামক এক ধরনের মৌমাছি দিয়ে এ চাষ করা হয়। কাঠের বাক্সে এক ধরনের ফ্রেমে মৌমাছিগুলো থাকে। সরষে ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে তারা এ ফ্রেমেই জমা করে। প্রতি সপ্তাহে এক থেকে দুই দিন এ ফ্রেমগুলো মধু বের করার মেশিনে দিয়ে মধু সংগ্রহ করা হয়।
টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর থেকে আসা মৌ-চাষি ঝুমুর আলী বলেন, তার খামারে ৭৫টি বাক্স বসানো হয়েছে। ৭৫টি বাক্স থেকে প্রায় ১২ মণ মধু উৎপাদন হয়েছে। প্রতি কেজি মধুু পাইকারি দরে আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ টাকা করে বিক্রি করা হয়।
গোপালপুর থেকে আসা মোহাম্মদ আলী নামের এক মধুচাষি জানান, তারা সরষে ক্ষেতের পাশে মৌমাছির সাহায্যে মধু সংগ্রহের জন্য চাকের বাক্স ফেলে রাখেন। সেই বাক্সে ১০-১৫টি পর্যন্ত মোম দিয়ে চাকের ফ্রেম রাখা হয়। বাক্সে একটি রানি মৌমাছি রাখা হয়। রানি মৌমাছির কারণে সরষে ক্ষেতের পাশে চাকের বাক্স যেখানেই রাখা হোক না কেন ওই বাক্সে মৌমাছিরা আসতে থাকে। চাকের বাক্সের মধ্যখানের নিচে ছিদ্র করে রাখা হয়। সে পথ দিয়ে মৌমাছিরা আসা-যাওয়া করতে থাকে। সরষে থেকে মধু সংগ্রহের পর মৌমাছিরা চাকের বাক্সে আসে। সরষে ফুল থেকে মৌমাছিরা নেকটার (পাতলা আবরণ) চাকের বাক্সে নিয়ে আসে। মৌমাছির তাপ ও বাতাসের মাধ্যমে ৬-৭ দিন পর তা গাঢ় হয়ে মধুতে পরিণত হয়। এরপর মধুচাষিরা চাকের বাক্স খুলে চাকের ফ্রেম থেকে মেশিনের মাধ্যমে মধু উৎপাদন করেন। এবার সরষেয় ফুল ভালো ধরেছে। ফুল বাড়ার কারণে মধুও বেশি পাওয়ার আশা করছেন তারা। যতদিন পর্যন্ত সরষেয় ফুল থাকবে, ততদিন পর্যন্ত তারা মধু সংগ্রহ করবেন।
টাঙ্গাইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর খামারবাড়ির উপ-পরিচালক মো. আবদুর রাজ্জাক জানান, মধুতে এন্টি-অক্সিজেন থাকে। প্রায় ১৮১টি রাসায়নিক দ্রব্য থাকে, যা মানুষের শরীরের কার্যক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে। চলতি বছরে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকায় মধুচাষিরা ইতোমধ্যে ৩০ হাজার কেজি মধু সংগ্রহ করেছে। আগামীতে এ মধুচাষিদের নিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার চিন্তা-ভাবনা চলছে। ইতোমধ্যেই কৃষক পর্যায়ে ডাল-তেল-চাল উৎপাদন ও মধু সংগ্রহের ওপর একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। এই প্রকল্পে মৌচাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ফলে তারা আরও লাভবান হতে পারবে। আর সরষে ক্ষেতের পাশে এ মধু চাষ করার ফলে সরষে চাষিরাও লাভবান হচ্ছেন। মৌমাছি পরগায়নে সাহায্য করায়, তাদের ফলনও অনেক বেড়ে যাচ্ছে।
হ শাহরিয়ার সিফাত, টাঙ্গাইল