নিজস্ব প্রতিবেদক: মন্ত্রী-এমপিদের নিকটাত্মীয়দের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর যে নির্দেশ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দিয়েছে, তা ‘আইনের মধ্যে পড়ে না’ বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান।
তিনি বলেছেন, নির্বাচন করার অধিকার সবারই আছে। যার বয়স ১৮ বছরের বেশি, যিনি ভোটার হয়েছেন, এরকম প্রত্যেকেরই নির্বাচন করার অধিকার আছে।
গতকাল বুধবার চট্টগ্রামে নগরীর আইস ফ্যাক্টরি রোডে প্রাইমারি টিচার্স ইনস্টিটিউটে মতবিনিময় সভায় এ মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘একটা বড় দল যারা এখন শাসক দল হিসেবে পরিচিত, তাদের দলীয় প্রধান, তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং ওই দলের সাধারণ সম্পাদক তিনিও বলেছেন, এমপি-মন্ত্রীদের অবস্থানের বিষয়ে বা তাদের আত্মীয়স্বজনের প্রার্থিতার বিষয়ে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। যদিও এটা আইনের মধ্যে পড়ে না, আইনের পরিপন্থি। এটা তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আমরা কিন্তু এটা বলিনি, কারণ এটা বলতে পারি না।
ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখে এই সভায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ মাঠপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন আনিছুর রহমান।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত রাখতে আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয়স্বজনদেরও প্রার্থী হতে নিষেধ করেছেন দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
‘দলীয় কোন্দল নিরসন এবং নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতেই’ এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে ক্ষমতাসীন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম জানিয়েছেন।
এরই মধ্যে দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকেরা নিজ নিজ বিভাগের মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের দলের এই নির্দেশ জানিয়ে দিয়েছেন। এরপরও কেউ ভোট থেকে সরে না দাঁড়ালে বহিষ্কারসহ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে।
আনিছুর রহমান মতবিনিময় সভায় বলেন, ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যা যা করণীয় এবং যা আপনারা করেছিলেন ৭ জানুয়ারিতে, সেসব একই জিনিস থাকবে। আপনারা কেউ কেউ বলবেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জাতীয় নির্বাচনে এত প্রভাব ছিল না। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীও যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। সে কারণে ন্যাচারালি একটা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স ছিল। এখন তো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা আছেন। মন্ত্রী মহোদয়রা আছেন। তাদের কিছু প্রভাব থাকতে পারে, বা ভিন্নতা আসতে পারে।’
দেশে এখন ৪৯৫টি উপজেলা রয়েছে। নির্বাচন উপযোগী ৪৮৫ উপজেলায় এবার চার ধাপে ৮ মে, ২১ মে, ২৯ মে ও ৫ জুন ভোট হবে। পরে মেয়াদোত্তীর্ণ হলে বাকিগুলোয় ভোটের আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারীদের উদ্দেশে আনিছুর রহমান বলেন, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদে যে নির্বাচন করেছি, সেই নির্বাচনের চেয়ে নিচে নামার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের ওই সময় যেমন দেশের মানুষ দেখেছে, আন্তর্জাতিক মহল যেমন দেখেছে, এখনও কিন্তু দেখবে। এই নির্বাচনকেও দেখবে। একটা দলীয় সরকার তখনও ছিল, এখনও দলীয় নতুন সরকার। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে যারা নির্বাচিত হয়েছে, সেই সরকারের আওতায় এখন কীভাবে করা হচ্ছে, এটাও কিন্তু দেখা হবে।’
আনিছুর রহমান বলেন, ‘এরই মধ্যে আপনারা জানেন যে, এই নির্বাচনেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো দলীয় প্রার্থী বা দলীয় অবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি, যাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশি হয় সে কারণে। এমনকি দলীয় প্রতীকও দেয়া হচ্ছে না। গতকাল যে প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য যে প্রতীক রাখা হয়েছিল, সেখান থেকে দেয়া হয়েছে। প্রার্থী কোনো কোনো জায়গায় বেশি আছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো। নির্বাচন বরাবরই প্রতিদ্বন্দ্বিতা পূর্ণ হয়। কারণ এটা আরেকটু ছোট এলাকার নির্বাচন। তাই অংশগ্রহণ বেশি হয়। সবচেয়ে অংশগ্রহণমূলক বেশি হয় ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন।’
ভোটার উপস্থিতি বাড়ার আশা প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বলেন, ‘এই নির্বাচনে মাত্র ৯টা জেলায় ইভিএমে করার ব্যবস্থা নিয়েছি। প্রথমেই কমিশন সিদ্ধান্তে আসছে, যে জেলায়ই ইভিএম হবে, সেখানে পুরো জেলার জন্য করব। একটা উপজেলায় ইভিএম করব একটাতে ব্যালটে করব, এটা সঠিক হবে না। পাশাপাশি আরও সিদ্ধান্ত ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট জেলাগুলোয় করা, যাতে আমরা পুরোটা কভার করতে পারি। এমপি সাহেবরা যাতে হস্তক্ষেপ না করেন, অবৈধ প্রভাব না খাটান, সেজন্য সরকারপ্রধান হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমাদের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। মাননীয় স্পিকারকেও জানানো হয়েছে, যাতে তিনি নির্দেশনা দেন এমপি মহোদয়দের।’
আনিছুর রহমান বলেন, ‘একটাই নির্দেশনা ভোটটাকে সুন্দর করতে হবে। যেখানেই কোনো অনিয়ম বা কারচুপি, অন্যায় কার্যক্রম হবে, সেখানে আমাদের নির্দেশনা থাকবেÑনিয়ন্ত্রণবহির্ভূত হলে ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেবেন। যতবার দরকার ততবার আমরা ভোট গ্রহণ করব।’
তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামে কিন্তু ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার ১৫ মিনিট আগে একজনের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে। কারণ বাতিল করার মতো উপাদান ছিল এবং তাকে আমরা সপ্তাহখানেক আগে থেকে তার অ্যাকটিভিটিজ ট্র্যাক করছিলাম, তাকে যখন কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। সবশেষ থানায় ঢুকে গিয়ে ওসিকে যখন মারধর করছেন, সার্কেল এসপি নিবৃত্ত করতে পারছেন না। এরপর আর বসে থাকা যায় না, তাহলে তো আমাদের আর অস্তিত্ব থাকে না। আমরা তো আর বসে থাকতে পারি না। তখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
আনিছুর রহমান বলেন, ‘গাইবান্ধায় ব্যাপক অনিয়ম হওয়ায় আমরা নির্বাচন বাতিল করে দিয়েছিলাম। আইন থাকলে হবে না। আইনের প্রয়োগ লাগবে। যে যেখানে ভোটের দিন থাকবেন আইনের সপক্ষে তা প্রয়োগ করবেন। এতে যদি কোনো বিপদগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, আমরা আপনাদের পাশে আছি। সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে কেউ চায় না ভোটটা খারাপ হোক। বারবার তিনি বলছেন, ভোট যেন ভালো হয়। ভোট সুন্দর, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য যে যে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন আপনারা নেবেন।’
বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল ইসলামের সভাপতিত্বে জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান, সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়, ডিআইজি নূরে আলম মিনাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন।