আরাফাত রহমান : বাংলাদেশ সরকার অতি সম্প্রতি সর্বজনীন পেনশন সুবিধা চালু করতে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ আইনের খসড়া প্রকাশ করেছে। সংবিধানের ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে নাগরিকদের সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার রয়েছে। দেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধিজনিত কারণে ক্রমবর্ধমান বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় আনা প্রয়োজন, কারণ ভবিষ্যতে কর্মক্ষম জনসংখ্যার হ্রাসজনিত কারণে নির্ভরশীলতার হার বৃদ্ধি পাবে। তাই সর্বজনীন পেনশন-সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক বিষয়ে বিধান করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
এই আইন ‘জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০২২’ নামে অভিহিত। ব্যক্তি পেনশন হিসাব অর্থ হচ্ছে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনার শর্তাবলি অনুসরণে চুক্তি অনুযায়ী চালু একজন চাঁদাদাতার হিসাব। দুস্থ চাঁদাদাতা হচ্ছেন পেনশন স্কিমে চাঁদা প্রদানকারী কোনো চাঁদাদাতা, যিনি শারীরিক বা মানসিক কারণে অসমর্থ হয়ে চাঁদা প্রদানের সক্ষমতা হারিয়েছেন। এই আইন কার্যকরের পর সরকার যথাশিগগির সম্ভব এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ নামে একটি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করবে।
সেই কর্তৃপক্ষ এই আইনের বিধানাবলি অনুসরণপূর্বক প্রয়োজনীয় সব ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে কার্যাবলি সম্পাদন করবে। যেমনÑসর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি চালু, ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ; সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতির আওতায় এর চাঁদাদাতাগণের স্বার্থ সংরক্ষণ; সর্বজনীন পেনশন স্কিম গ্রহণ, স্কিমে প্রবেশ যোগ্যতা, শর্তসমূহ নির্ধারণ, অনুমোদন, স্কিম পরিচালনা, তত্ত্বাবধান এবং পেনশন তহবিলের পুঞ্জীভূত জমার বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা।
পেনশন স্কিমে চাঁদাদাতাগণের জমাকৃত অর্থের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ; চাঁদাদাতাগণের অভিযোগ নিষ্পত্তি ও প্রতিকার প্রদান নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সরকারের অনুমোদন ক্রমে প্রয়োজনীয় প্রবিধান প্রণয়ন; কর্তৃপক্ষ স্বয়ং অথবা অপর কোনো কার্যালয় বা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে কর্তৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা, বাস্তবায়ন বা এ বিষয়ে কোনো গবেষণার নিমিত্ত তথ্য সংগ্রহ বা গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা; জনসাধারণের মধ্যে সর্বজনীন পেনশনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, অবসরকালীন নিরাপত্তা ও পেনশন সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদান এবং বহুল প্রচারের মাধ্যমে পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণ উৎসাহিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ।
সর্বজনীন পেনশন স্কিমের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ; সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে ফি বা অন্যান্য চার্জ নির্ধারণ; নির্ধারিত স্থান এবং সময়ে, হিসাব সংরক্ষণ বই ও অন্য দালিলিক কাগজপত্র প্রকাশ এবং সর্বজনীন পেনশন বা পেনশন তহবিল বা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে কোনো অভিযোগ বা বিরোধ নিষ্পত্তির বা অনিয়ম সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা গ্রহণ।
এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে কর্তৃপক্ষ সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে নিজ নামে ঋণ গ্রহণ করতে পারবে। সর্বজনীন পেনশন স্কিম বা এই স্কিমের আওতাধীন কোনো কার্যক্রম, স্কিম অথবা প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা কর্মচারী এই আইনের কোনো ধারা অথবা এর অধীনে প্রণীত কোনো বিধি বা প্রবিধানের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে আদালতের মাধ্যমে ওই ব্যক্তি বা কর্মচারীর এক বা একাধিক ব্যাংক হিসাব ক্রোক করা যাবে।
গভর্নিং বোর্ড প্রয়োজনে যেকোনো ব্যক্তিকে গভর্নিং বোর্ডের সদস্য হিসাবে কো-অপ্ট করতে পারবে বা সভায় অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারবে। গভর্নিং বোর্ড এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে এই আইনের অধীন প্রবিধান প্রণয়নসহ কর্তৃপক্ষের যে কোনো নীতি বা কৌশল অথবা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক উত্থাপিত কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অথবা কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ প্রদান করবে। গভর্নিং বোর্ড পেনশন তহবিলের অর্থ সরকারি সিকিউরিটি, কম ঝুঁকিপূর্ণ অন্যান্য সিকিউরিটিজ, লাভজনক অবকাঠামো প্রভৃতি খাতে বিনিয়োগের জন্য নির্ধারিত গাইডলাইন অনুমোদন এবং সময়ে সময়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ বা দিকনির্দেশনা দেবে।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ তহবিল নামে কর্তৃপক্ষের একটি তহবিল থাকবে এবং তাতে নিন্মবর্ণিত অর্থ জমা হবে; যথা (ক) সরকার কর্তৃক প্রদত্ত অনুদান; (খ) এই আইনের অধীন আদায়যোগ্য ফি ও চার্জ; (গ) কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত সেবা বাবদ প্রাপ্ত অর্থ; (ঘ) সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে গৃহীত ঋণ; এবং (ঙ) অন্য কোনো উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থ। তহবিলের অর্থ কর্তৃপক্ষের নামে কোনো তফসিলি ব্যাংকে জমা রাখা হবে এবং কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত পদ্ধতিতে এই তহবিল থেকে অর্থ ওঠানো যাবে।
সরকার অবিলম্বে সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা নি¤œবর্ণিত বৈশিষ্ট্য-সংবলিত বা শর্তে বা পদ্ধতিতে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন করবে, যথাÑ(ক) জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি ধরে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনার আওতায় ১৮ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়স থেকে ৫০ বছর বয়সী সব বাংলাদেশি নাগরিক অংশগ্রহণ করতে পারবে; (খ) বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীরা এ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে; (গ) অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাক না কেন, সরকার কর্তৃক সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়া পর্যন্ত সরকারি ও আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত-কর্মচারীগণ সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতা-বহির্ভূত থাকবে। (ঘ) সরকার কর্তৃক সরকারি গেজেটে বাধ্যতামূলক করে প্রজ্ঞাপন জারি না করা পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তি স্বেচ্ছাধীন থাকবে; (ঙ) সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্তির পর একজন চাঁদাদাতা ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা প্রদান সাপেক্ষে মাসিক পেনশন পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে এবং চাঁদাদাতার বয়স ৬০ বছর পূর্তিতে পেনশন তহবিলে পুঞ্জীভূত মুনাফাসহ জমার বিপরীতে পেনশন প্রদান করা হবে; (চ) প্রতিটি চাঁদাদাতার জন্য একটি পৃথক ও স্বতন্ত্র পেনশন হিসাব থাকবে, যা এই আইনের অধীনে প্রণীত বিধি পরিচালিত হবে। (ছ) চাকরিরত চাঁদাদাতাগণ চাকরি পরিবর্তন করলেও পূর্ববর্তী হিসাব নতুন কর্মস্থলের বিপরীতে স্থানান্তরিত হবে, নতুনভাবে হিসাব খোলার প্রয়োজন হবে না; (জ) কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মাসিক সর্বনিন্ম চাঁদার হার নির্ধারিত হবে। মাসিক ও ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে চাঁদা প্রদান করতে পারবে এবং অগ্রিম ও কিস্তিতে জমা প্রদানের সুযোগ থাকবে; (ঝ) মাসিক চাঁদা প্রদানে বিলম্ব হলে, বিলম্ব ফি-সহ বকেয়া চাঁদা প্রদানের মাধ্যমে পেনশন হিসাব সচল রাখা যাবে এবং ওই বিলম্ব ফি চাঁদাদাতার নিজ হিসাবে জমা হবে। (ঞ) পেনশনারগণ আজীবন অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পেনশন সুবিধা ভোগ করবেন; (ট) পেনশনে থাকাকালে ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে মৃত্যুবরণ করলে পেনশনারের নমিনি অবশিষ্ট সময়কালের অর্থাৎ মূল পেনশনারের বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত মাসিক পেনশন প্রাপ্য হবেন; (ঠ) কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা প্রদান করার পূর্বে চাঁদাদাতা মৃত্যুবরণ করলে জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেয়া হবে। (ড) পেনশন তহবিলে জমাকৃত অর্থ কোনো পর্যায়ে এককালীন উত্তোলনের প্রয়োজন হলে, চাঁদাদাতার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জমাকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসাবে উত্তোলন করা যাবে, যা ধার্যকৃত ফি-সহ পরিশোধ করতে হবে এবং ফি-সহ পরিশোধিত অর্থ চাঁদাদাতার নিজ হিসাবেই জমা হবে; (ঢ) পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে এবং মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে। (ণ) সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতিতে সরকারি অথবা আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত অথবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করতে পারবে। এক্ষেত্রে কর্মী ও প্রতিষ্ঠানের চাঁদার অংশ জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত হবে; এবং (ত) সরকার কর্তৃক সময় সময় প্রজ্ঞাপন জারি হওয়া সাপেক্ষে নি¤œ আয়সীমার নিচের নাগরিকগণের অথবা দুস্থ চাঁদাদাতার ক্ষেত্রে পেনশন তহবিলে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে প্রদান করতে পারবে।
কর্তৃপক্ষ সরকারের সহিত পরামর্শক্রমে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা পরিচালনা, পেনশন তহবিল ব্যবস্থাপনা, চাঁদাদাতার চাঁদা জমাকরণ, পেনশনের অর্থ প্রদান ইত্যাদি প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক সম্মুখ অফিস প্রতিষ্ঠা বা পেনশন সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি অথবা নিয়োগ ও পরিচালনা করতে পারবে। এই আইনের আওতায় চাঁদাদাতার সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপনকারী প্রতিষ্ঠানই হবে পেনশনের সম্মুখ অফিস। তফসিলি ব্যাংক এবং ডাক অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কার্যালয়সমূহ এবং বিধি দ্বারা নির্ধারিত অন্য কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পেনশনের সম্মুখ অফিস হিসেবে কাজ করবে।
সর্বজনীন পেনশন তহবিলে চাঁদাদাতার চাঁদা জমা, জমার হিসাব সংরক্ষণ, পুঞ্জীভূত অর্থের সুষ্ঠু ও নিরাপদ বিনিয়োগ এবং পেনশন প্রদানসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রম সম্পাদন করবে। এই আইনের আওতায় পেনশন কার্যক্রমে রেকর্ড সংরক্ষণের জন্য বিধি দ্বারা নির্ধারিত কেন্দ্রীয় রেকর্ড কিপিং ব্যবস্থা থাকবে। চাঁদার মাধ্যমে সংগৃহীত পেনশন তহবিল বিভিন্ন পোর্টফোলিওতে বিনিয়োগের বিষয়টি বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে।
বিধি দ্বারা নির্ধারিত এক বা একাধিক তফসিলি ব্যাংক জাতীয় পেনশন তহবিলের ব্যাংকার হিসেবে কাজ করবে। চাঁদাদাতা পেনশন বয়সে উপনীত হলে এই আইনের আওতায় বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে কর্তৃপক্ষ অ্যান্যুইটি সার্ভিস দেবে। কর্তৃপক্ষ ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার প্রক্রিয়ায় মাসিক পেনশন পেনশনারের নিকট নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছানো নিশ্চিত করবে। এ লক্ষ্যে একটি কেন্দ্রীভূত ও স্বয়ংক্রিয় পেনশন বিতরণ পরিকাঠামো গঠন করা হবে।
সহকারী কর্মকর্তা
ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট
সার্ভিসেস বিভাগ
সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়