নিজস্ব প্রতিবেদক: বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে করহার সর্বোচ্চ। উচ্চ করহারের কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে করফাঁকির প্রবণতা বাড়ছে। নিচের দিকে করদাতাদের স্বস্তি দেওয়া ও করজাল বিস্তারের জন্য আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সর্বনিম্ন করহার কমানো হতে পারে। সেক্ষেত্রে বিদ্যমান করের সঙ্গে সর্বনিম্ন সাত শতাংশের একটি স্তর যোগ হতে পারে। ইতোমধ্যে অর্থমন্ত্রী এ বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন। এনবিআর বলছে, সর্বনিম্ন স্তরের কারণে কয়েক লাখ নতুন করদাতা করজালে আসবে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ টাকা, যা গত দুই অর্থবছর ধরে বহাল রয়েছে। আগামী অর্থবছর তা বাড়ানো হতে পারে। পরবর্তী চার লাখ টাকা পর্যন্ত করহার ১০ শতাংশ, পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫ শতাংশ, ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত ২০ শতাংশ, ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত ২৫ শতাংশ এবং অবশিষ্ট আয়ের ওপর ৩০ শতাংশ। দেশে সর্বোচ্চ করহারের কারণে ফাঁকির পরিমাণ বাড়ছে এবং করযোগ্য অনেক ব্যক্তি করের আওতায় আসছে না বলে বিভিন্ন সংগঠন দাবি করে আসছে। করফাঁকি রোধ ও করজাল বাড়াতে করহার কমানোর দাবি জানিয়ে আসছেন তারা। তবে করদাতার সংখ্যা কম, করহার কমানো হলে রাজস্ব আয়ে প্রভাব পড়বে বলে জানিয়েছে এনবিআর। সেজন্য করহার কমানো নয়, সর্বনিম্ন করহার কমানোর মাধ্যমে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের স্বস্তি দেওয়ার প্রস্তাব করেছে এনবিআর। সে অনুযায়ী আগামী বাজেটে সর্বনিম্ন করহার কমানো হতে পারে বলে জানা গেছে।
প্রাক-বাজেট আলোচনায় ব্যবসায়ী সংগঠন ও গবেষণা সংস্থার পক্ষ থেকে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো ও করহার কমানোর সুপারিশ করা হয়। এর জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের দেশে করদাতার সংখ্যা অনেক কম। এর মধ্যে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হলে অনেকেই করজাল থেকে বেরিয়ে যাবে। আমরা করযোগ্য অনেককে করের আওতায় আনতে পারছি না। সেজন্য আগামী বাজেটে বিদ্যমান করহারের সঙ্গে সাত থেকে সাড়ে সাত শতাংশের একটি করহার যোগ করার চিন্তা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে নিচের দিকের করদাতাদের ওপর চাপ কমবে। কয়েক লাখ নতুন করদাতা করজালের আওতায় চলে আসবে।
এনবিআর সূত্র জানায়, দেশে প্রায় এক কোটির বেশি করযোগ্য ব্যক্তি রয়েছে। কিন্তু মাত্র ১৮ লাখ মানুষ কর দেয়। করযোগ্য ব্যক্তিকে করের আওতায় আনতে করহারকে বাধা হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি এক প্রাক-বাজেট আলোচনায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, করদাতার সংখ্যা আশাতীতভাবে বেড়েছে ও বাড়ছে। আগে যেখানে ১৪-১৫ লাখ করদাতা ছিল, বর্তমানে তা ৩৩ লাখ ছাড়িয়েছে। নতুন করদাতাদের বেশিরভাগের বয়স ৪০-এর নিচে। তরুণ করদাতারা বলছে, কর দেওয়া তাদের কর্তব্য। রাষ্ট্রের জন্য কিছু করার মানসিকতা থেকে তারা কর দিচ্ছে। চলতি অর্থবছর করদাতার সংখ্যা ৩০ লাখে উন্নীত করার লক্ষ্য থাকলেও তা ৪০ লাখ হয়ে যাবে। করহার বিষয়ে তিনি বলেন, আগামী বাজেটে করহার কমানোর চিন্তা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহলের কাছে করহার কমানোর যুক্তি তুলে ধরেছি। ভয়ে আমরা এত বছর করহার খুব একটা কমাইনি। করদাতার সংখ্যা ইতোমধ্যে যেহেতু নিশ্চিত হয়ে গেছে, সেহেতু আগামী বাজেটে করহার কমানো হবে।
প্রাক-বাজেট আলোচনায় এফবিসিসিআই, ডিসিসিআই, এমসিসিআই, বিসিআইসহ বড় সব সংগঠনের পক্ষ থেকে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো ও করহার কমানোর সুপারিশ করা হয়। বলা হয়, উচ্চ করহারের কারণে মূলধন পাচার বাড়ছে। নতুন করদাতা করের আওতায় আসছে চায় না।
পিআরআই’র নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশে করের হার অনেক বেশি, কিন্তু কর আদায় কম। মোট রাজস্ব আয়ের মাত্র তিন শতাংশ ব্যক্তিশ্রেণির আয়কর থেকে আসে। যুক্তরাজ্যে এই হার প্রায় ৮৬ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়াতে ৬২ শতাংশ, ভারতে ১১ দশমিক ১০ শতাংশ এবং মালয়েশিয়ায় সাত দশমিক ছয় শতাংশ। জিডিপির অনুপাতে কর আদায়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে বাংলাদেশ। জিডিপির বিপরীতে বর্তমানে বাংলাদেশে কর আদায় ১০ দশমিক দুই শতাংশ। কিন্তু ভারতে এই হার ১৬ দশমিক ছয় শতাংশ, নেপালে ১৪ দশমিক চার শতাংশ, পাকিস্তানে ১০ দশমিক ছয় শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় ১২ দশমিক চার শতাংশ কর আদায় হচ্ছে। তিনি করমুক্ত আয়সীমা নয়, করহার কমিয়ে করদাতার সংখ্যা বাড়ানোর পরামর্শ দেন।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বৈষ্যমের কারণে করদাতা বাড়ছে না। যারা কর দিচ্ছে তাদের কাছ থেকে বেশি কর আদায়ের চেষ্টা করা হয়। ফলে টাকা বাইরে চলে যায়। এছাড়া সমন্বয় আর তদারকির অভাবে একটি করযোগ্য ব্যক্তির একটি অংশকে করের আওতায় আনা যাচ্ছে না।
সূত্র আরও জানায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রায় ১৮ লাখ আয়কর রিটার্ন দাখিল হয়েছে। কিন্তু ই-টিআইএন নিবন্ধন নিয়েছেন প্রায় ৩৩ লাখ। আগামী অর্থবছর আয়কর খাতে প্রায় ৯৭ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরে ৮৭ হাজার ১৯০ কোটি টাকা।
বিশ্বব্যাংক ও প্রাইসওয়াটারহাউসকুপারসের এক প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সার্বিকভাবে করবান্ধব বা কর প্রদান সূচকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৯ দেশের মধ্যে ১৫১তম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এ সূচকে বাংলাদেশ চতুর্থ। কোনো দেশে করহার কত, সেদিক থেকেও এ অঞ্চলে চতুর্থ বাংলাদেশ। বাংলাদেশে করপোরেট কর, মূল্য সংযোজন করসহ সব মিলিয়ে গড় করহার ৩৪ দশমিক চার শতাংশ। এ দেশে এখন ৩৩ ধরনের কর পরিশোধ করতে হয়। বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এ সূচকে ৩৬তম। যুক্তরাষ্ট্রে সব মিলিয়ে করহার গড়ে ৪৪ শতাংশ। অন্যদিকে অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীনের অবস্থান সূচকে ১৩১তম। চীনে সব মিলিয়ে করহার গড়ে ৬৮ শতাংশ।