মাসুম বিল্লাহ ও রহমত রহমান: দেশের ৪৯তম বাজেট ঘোষিত হতে যাচ্ছে আজ। তবে দিনটি স্বাভাবিক সময়ের বাজেট ঘোষণার মতো নয়। অন্য বছরগুলোয় বাজেটকে কেন্দ্র করে জাতীয় সংসদে যে উৎসবমুখর আবহ সৃষ্টি হয়, এবার তা থাকছে না। করোনাভাইরাসজনিত রোগ কভিড-১৯ সংক্রমণের ঝুঁকি এবারের পুরো বাজেট প্রক্রিয়াকেই ওলট-পালট করে দিয়েছে। তাই এবারের বাজেট করোনাকালীন বাজেট। এ বৈশ্বিক মহামারির কারণে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই কাক্সিক্ষত রাজস্ব আহরণ সম্ভব হবে না। এমন পরিস্থিতিতে বড় অঙ্কের বাজেট ঘোষণা করতে হলে ঘাটতির আকারও বাড়বে। স্বাভাবিক নিয়মে বাজেটের ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয় দেশের মোট জিডিপির পাঁচ শতাংশ। এবার তা ছয় শতাংশে উঠে যেতে পারে। আর টাকার অঙ্কেও এবারের ঘাটতি হবে সর্বোচ্চ। এ ঘাটতি মোকাবিলায় দেশীয় ও বৈদেশিক উৎস থেকে সরকারকে ঋণ নিতে হবে। পাশাপাশি এবারের বাজেটে কর কাঠামোয় একগুচ্ছ পরিবর্তন থাকবে বলেই জানা যাচ্ছে।
বিভিন্ন সূত্রের তথ্য মতে, আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের আকার হবে ৫ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের ঘোষিত বাজেটের আকার ছিল ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে বাজেটের আকার বাড়ছে প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বাজেটের আকার বাড়লেও রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। কারণ করোনার ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যে ধাক্কা লেগেছে, তা সামলে উঠে বাড়তি রাজস্ব সংগ্রহ সম্ভব হবে না। এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী অর্থবছরের জন্য দেশীয় উৎস থেকে মোট রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নেওয়া হচ্ছে ৩ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের এর পরিমাণ ধরা হয়েছিল ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রাক্কলিত রাজস্বের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আয় করতে হবে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। করবহির্ভূত রাজস্ব আহরণ করতে হবে ১৫ হাজার কোটি টাকা এবং কর ছাড়া অন্য খাত থেকে আয়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে ৩৩ হাজার ৩ কোটি টাকা। এর বাইরে বৈদেশিক অনুদান ও বাজেট সহায়তার পরিমাণ প্রাক্কলন করা হচ্ছে ১০ হাজার কোটি টাকার মতো। এবারের বাজেটে ঘাটতি হবে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ ঘাটতি এটি। এক লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাংক খাত থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি, সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার কোটি ও অন্যান্য খাত থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের প্রাক্কলন করা হচ্ছে। আর বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে কর কাঠামোয় বেশকিছু নতুন বিষয় সংযোজিত হতে পারে। এর মধ্যে একটি হলো ‘কভিড-১৯ কর’। আগামী বাজেটে করোনা মহামারির অভিঘাত মোকাবিলায় কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ প্রসারিত করার কথা ভাবছে সরকার। এ নিয়ে হিসাব কষা হয়েছে। বিশেষ করে ঝিমিয়ে পড়া আবাসন খাত, উদীয়মান অর্থনৈতিক অঞ্চল ও সম্ভাবনাময় হাইটেক পার্কের পাশাপাশি ট্রেজারি বন্ড, বিভিন্ন শিল্পে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হতে পারে। সিগারেটের মূল্যস্তর কমিয়ে বাড়ানো হবে শুল্ককর। এছাড়া ধূমপায়ীদের করোনা ঝুঁকি বেশি। ফলে ধূমপানে নিরুৎসাহিত করতে বিদ্যমান করের পাশাপাশি ‘কভিড-১৯ ট্যাক্স’ নামে একটি নতুন করারোপ করা হতে পারে। বিলাসী পণ্যের মধ্যে প্রসাধনী, মোবাইল, গাড়িসহ বেশ কয়েকটি পণ্যে কর বাড়তে পারে।
সূত্রমতে, আগামী বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়তে পারে। বর্তমানে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ টাকা। এটি বাড়িয়ে ৩ লাখ টাকা করা হতে পারে। গত আট বছরের বাজেট বিশ্লেষণে দেখা যায়, সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হয়েছিল। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে করমুক্ত আয়ের সীমা ছিল দুই লাখ ২০ হাজার টাকা। এটিকে বাড়িয়ে তখন আড়াই লাখ টাকা করা হয়।
আগামী বাজেটে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ‘আয়কর’ জালের আওতা কমতে পারে। নতুন ৫ লাখ আয়করদাতাকে করজালে যুক্ত করার ঘোষণা আসতে পারে। নতুন এ আয়করদাতার সংখ্যা চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৪ লাখ ২৩ হাজার জন কম। চলতি সংশোধিত বাজেটে নতুন আয়করদাতার সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় ৯ লাখ ২৩ হাজার।
করোনাভাইরাসের কারণে মানুষের আয়-রোজগার কমেছে। আগামী বাজেটে ভ্যাটে ছাড়, হার কমানো, আইন-কানুন সহজীকরণ, কর ফাঁকি রোধ ও সংস্কার জোরদার করে মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। এছাড়া বর্তমানে মূলধনি যন্ত্রপাতি, অত্যাবশ্যকীয় ও সামরিক সরঞ্জাম, ত্রাণসামগ্রীসহ কিছু পণ্য ছাড়া বাকি সব পণ্য আমদানিতে ৫ শতাংশ অগ্রিম কর দিতে হয়। তবে এ কর মাসিক ভ্যাট রিটার্ন জমা দেওয়ার সময় ফেরত দেওয়া হয়। আগামী বাজেটে অগ্রিম করের দুটি স্তর করা হচ্ছে। শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালের জন্য এ কর হবে ৩ শতাংশ। আর যারা বাণিজ্যিকভাবে পণ্য আমদানি করবে, তাদের জন্য ৫ শতাংশই বহাল রাখা হচ্ছে।
সূত্র আরও জানায়, ব্যাংক আমানতের কর কাঠামোতেও কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে। এখন আমানতের ওপর পাঁচ ধাপে আবগারি শুল্ক কাটা হয়। বছর শেষে একবার স্থিতির ওপর প্রযোজ্য হারে কাটা হয়। শেষ ধাপে যাদের ব্যাংক হিসাবে পাঁচ কোটি টাকার বেশি থাকবে, তাদের ওপর শুল্কহার বাড়তে পারে। এখন পাঁচ কোটি টাকার বেশি অর্থে ২৫ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক বিদ্যমান। এ স্তরে ১৫ শতাংশ শুল্ক বাড়তে পারে।
করোনায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ফলে তাদের কিছুটা ভ্যাট ছাড় দেওয়া হতে পারে। বর্তমানে ৫০ লাখ টাকা থেকে তিন কোটি টাকা পর্যন্ত বছরে লেনদেন বা বিক্রয় হলে তারা ১৫ শতাংশের পরিবর্তে ৪ শতাংশ হারে টার্নওভার কর দেন। তাদের জন্য টার্নওভার কর কমিয়ে ৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হতে পারে। সিগারেট খাতের কর কাঠামোতে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে। মধ্যম স্তর ও বিড়ির মূল্যস্তর বর্তমানের চেয়ে ৫ থেকে ১০ শতাংশ বাড়তে পারে। ফলে সিগারেট ও বিড়ির দাম কিছুটা বাড়তে পারে। সেবা খাত বিশেষ করে হোটেল-রেস্তোরাঁর ভ্যাট হারে পরিবর্তন আসতে পারে। করোনায় এ খাতের ব্যবসা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে ভ্যাট হার বর্তমানের চেয়ে আড়াই শতাংশ কমতে পারে, যা এখন আছে সাড়ে ৭ শতাংশ। আগামী বাজেটে ভ্যাট হার ও আওতা তেমন বাড়বে না। তবে সংস্কারে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে।
আগামী বাজেটে করপোরেট কর কমানোর কথা ভাবা হচ্ছে। বিশেষ করে ব্যাংক খাতে। বর্তমানে ব্যাংক খাতে করপোরেট কর সাড়ে ৩৭ শতাংশ। এটি ৩৫ শতাংশ হতে পারে। অন্যদিকে, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে করপোরেট কর কমাতে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) দাবি জানালেও গত কয়েক বছরে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। এবার করোনার ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে করপোরেট কর কমানো হতে পারে।
গত ৫ বছর ধরে পুঁজিবাজারে তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির করহার ৩৫ শতাংশ বহাল আছে। এরপর তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও কয়েক দফায় ব্যাংকের করপোরেট কর কমানো হয়েছে। কিন্তু তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির কর কমানো হয়নি। এবার উৎপাদনশীল খাতের কোম্পানির করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমানো হতে পারে।
আগামী বাজেটে ব্যক্তিগত গাড়ি নিবন্ধনে অগ্রিম আয়কর বাড়তে পারে। এতে গাড়ি নিবন্ধনের ব্যয় বাড়বে। বর্তমানে প্রাইভেটকার মালিকদের সিসিভেদে নিবন্ধন বা পুনঃনিবন্ধনের সময় অগ্রিম আয়কর দিতে হয়।